বাংলা কবিতার ‘বৌদ্ধ’ আবহাওয়া এবং কবি নজরুল ইসলাম



কর্ণকে নিয়ে মহাভারতে যে ঝামেলাটা তৈরি হয়েছিল, ব্যাসদেব এবং তাঁর পরবর্তী লেখকরা যে ফুটো চৌবাচ্চাটির মুখোমুখি হয়েছিলেন, কবি নজরুল ইসলামকে নিয়ে সেই একই গাণিতিক সমস্যা তৈরি হয় বাংলা কবিতার এলিট-আঁতেল মহলে - ‘এই লোকটাকে আমরা রাখব কোথায়? কী দেব তার পরিচয়? কোথায় বসাব?’ এমনকি নজরুল ইসলাম যখন আপামর বাঙালির মুখে মুখে আজও এই ২০১৯-এও কবি-পরিচয়ের অন্যতম নাম, বাঙালি যখন কবি বলতে আজও মাইকেল-রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-সুকান্ত এই চারটে নামকেই বোঝে, এঁদের মুখই ভেসে ওঠে তার সামনে, যখন অগণিত প্রতিষ্ঠানের গেটে নজরুলের মূর্তি শোভিত, বিদ্যালয়-মহাবিদ্যালয়ের স্টাফরুমে নজরুলের বিপুল প্রতিকৃতি সসম্মানে ঝুলছে, ঠিক তখনই বাংলার এলিট মহলে এবং ইন্টেলেকচ্যুয়ালদের মুখে দুখু মিঞা সম্পর্কে প্রায় এক অখণ্ড নীরবতাও বিরাজ করছে। এই নীরবতা মধ্যবিত্ত বাঙালির মজ্জাগত ভণ্ডামি থেকে জন্মেছে। সেটা নিয়েই বলি।
নজরুল ইসলামের কবিতাসংগ্রহ ‘সঞ্চিতা’ নেই, প্রায় এমন কোনো লাইব্রেরি দুই বাংলায় নেই। ‘অগ্নিবীণা’ বা ‘বিষের বাঁশি’ আজকের যে কোনো কবির কাব্যগ্রন্থের চেয়ে বেশি বিক্রি হয়। অথচ, নজরুল ইসলাম সম্পর্কে পাঠ্যপুস্তকের বাইরে কোনো আলোচনাই নেই। এ এক প্যারাডক্স। নজরুল যা লিখে গেছেন, যা প্রায় অমর হয়েছে, সেগুলোকে কবিতা বলা যায় কি না, এই নিয়েও বিশেষ করে মহানগরের তথাকথিত তাত্ত্বিকদের মধ্যে এক বিচিত্র দ্বিধা আমি লক্ষ্য করি, এবং হতাশা বোধ করি। নজরুল ইসলাম নামক বেখাপ্পা লোকটাকে তার দুর্ধর্ষ শক্তি আর অস্ত্রসম্ভার নিয়েও কবিতা-কুরুক্ষেত্রে নামতে দেওয়া যায় কি না, সেই সিদ্ধান্তই যেন তাঁরা নিতে পারেননি। ১৯৪২ সালে নজরুল ইসলাম যদি মূক না হয়ে যেতেন, হয়ত নিজের বিচার নিজে ছিনিয়ে নিতেন। কিন্তু সেটা হয়নি। যেমন আমরা জানি না জীবনানন্দ দাশ নামক কবিটি ১৯৭৫ খৃস্টাব্দ অবধি জীবিত থাকলে বাংলা কবিতার গতিপ্রকৃতি কী হত! নজরুল ইসলাম আর জীবনানন্দ দাশ যদি ১৯৭৫ অবধি সক্রিয় থাকতেন, বাংলা কবিতার প্রাতিষ্ঠানিক চেহারাটা কেমন হত? কেমন হত তার বিদ্যায়তনিক অবয়ব। আমরা জানি না। কল্পনাই করতে পারি।
নজরুল ইসলামকে কবি হিসেবে তাঁর প্রাপ্য দিলে কি জীবনানন্দ দাশ বা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বা শক্তি চট্টোপাধ্যায় বা উৎপলকুমার বসু বা প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত বা ভাস্কর চক্রবর্তী বা তুষার চৌধুরীর কবি-পরিচয় নিয়ে কোনো বিভ্রান্তির সম্মুখীন হন মননশীল পণ্ডিতরা? কবিতা কাকে বলে, এটা যেহেতু আজ অবধি কেউই বলে উঠতে পারেননি, যেহেতু মানুষ আজ অবধি কোনো রহস্যকেই পুরোপুরি সহ্য করে উঠতেও পারেনি, যে কোনো একটা ব্যাখ্যায় যেতে চেয়েছে, তাই কবিতা কী নয়, সেই ধারণা দিয়েই যুগে যুগে কবিতাকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা হয়েছে। যখন একজন বলেন, “এই লেখাটা কবিতা নয়।”- তিনি সেটাকে একরকম একপেশে যুক্তি দিয়ে প্রতিষ্ঠা করতে পারেন, প্রচুর তর্ক করেও তাঁকে কাত করা যায় না তাঁর সেই একপেশে যুক্তি আরো অনেক মানুষকে প্রভাবিতও করতে পারে। কিন্তু যখন একজন বলেন, “আহা! এই তো কবিতা!” – তখন তিনি আর যুক্তির দিক থেকে আসতে পারেন না, তর্ক একটু গড়ালেই তিনি রক্তাক্ত হনঅথচ, কবিতা কী নয়, এটাও কি বলা যায়?
যখন একজন বলেন কবিতা শ্লোগান নয়, তিনি পৃথিবীর অনেক মহৎ কবি ও তাঁদের কবিতাকে অস্বীকার করেন। যখন একজন বলেন কবিতা উচ্চকিত নয় অথবা কবির নিবিড় জীবনের বাইরে সে কোনো উচ্চারণ হতে পারে না, তিনিও পৃথিবীত অনেক মহৎ কবিতাকে অপমানিতই করেন। কবিতা মগ্নও হয়, কবিতা নগ্নও হয়। ব্রহ্ম এবং প্রেমের মতোই কবিতাকে আজ অবধি অনুচ্ছিষ্ট রাখা গেছে, তার ফলেই আজও বিভিন্ন রকমের কবিতার বিবিধ সাধনা সারা পৃথিবীতে ব্যাপ্ত রয়েছে। প্রাচীন জেন কবিরা যা লিখেছেন, সে যেমন কবিতা, নিকানোর পাররা বা পাবলো নেরুদা যা লিখেছেন, সেও তো কবিতা। কৃত্তিবাস ওঝা যেমন কবি, সিলভিয়া প্ল্যাথও একজন কবি। অথচ, যুগে যুগে কবিতা সম্পর্কে এক-একটা বিশেষ ধারণা যখন প্রতাপশালী হয়ে উঠেছে, খুবই সহজে এমন কিছু কবিকে আলোচনার বাইরে রাখা গেছে, যাঁর কবিতায় পৃথিবীর জল-মাটি-হাওয়া অনেক বেশি সতেজ, যাঁর কবিতায় মানুষ নিজের মুখের ভাষা খুঁজে পেয়েছে, এমনকি তিনি হয়ত প্রকৃত অর্থেই একজন জনপ্রিয় কবি, জনগণের কবি, people’s poet গণবিমুখতার মতোই জনপ্রিয়তাও ক্ষেত্রবিশেষে কবির অপরাধ হয়ে যায়। তাঁকে তখন বাঙালির নির্জীব আলোচনার শুকনো খোপে খাপ খাওয়ানো যায় না।
গত পঞ্চাশ বছরে বাংলা কবিতার ইতিহাস নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির ইতিহাসে পরিণত হয়েছে। এটা শুরু হয়েছে পঞ্চাশের দশক থেকেই। আর পাঠক? ক্লাস সিক্স থেকে ইংরেজি পড়া, কুমুদরঞ্জন মল্লিকের কবিতা মানেবই খুলে পড়া, আর সপ্তাহে তিনটে বাংলা ব্যাকরণের ক্লাস করা একটা প্রজন্ম আজ সারা পশ্চিমবঙ্গে সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করছে। যদিও বিদ্যায়তনিক শিক্ষার কোনো মূল্য সাহিত্যে নেই, তবু পাঠকের প্রস্তুতির ক্ষেত্রে শিক্ষাব্যবস্থার ভূমিকা যে আছেই এটা অস্বীকার করা যায় না। আজকের এই প্রজন্মের, অর্থাৎ যাদের বয়স আজ ৩৫ থেকে ৫০-এর মধ্যে, এদের সাহিত্য-হজমশক্তি খুবই ক্ষীণ। এই প্রজন্মে যারা সাহিত্য নিয়ে মেতে আছে তাদের ব্যতিক্রম মনে হয়। বাংলা মিডিয়াম ইস্কুলগুলোর ক্রমিক অধঃপতনের সঙ্গেই, এবং বাংলা সিলেবাসের সরলীকরণের ফলে এরাও অবক্ষয়িত হয়েছে। এরা আজ মহৎ শিল্প-সাহিত্য-চলচ্চিত্রের সামনে অসহায় বোধ করে। বিরাট ব্যক্তিত্বের সামনে এরা নির্বল সাপের মতো হীনমন্যতার শিকার হয়। যা কিছু ম্রিয়মাণ ও মাঝারি মানের, তার প্রতিই এদের অনুরাগ। এরা প্রতিষ্ঠানের দিকে তাকিয়ে থাকে, এবং তাদের গ্রন্থতালিকাকেই ইস্কুলের বুকলিস্টের মতো সংগ্রহ করে, এবং সাধ্যমতো পড়ে। আর যারা ইংলিশ মিডিয়াম থেকে বেরোচ্ছে বা বেরিয়েছে, তাদের দ্বারা বাংলা সাহিত্যের কোনো মঙ্গলসাধন বা সম্প্রসারণ সম্ভব বলে বোধ হয় না। উত্তম-সুচিত্রার বাংলা সিনেমাও এদের সাবটাইটেল নিয়ে দেখতে হবে। কিছু ব্যতিক্রম থাকতেই পারে, অবশ্যই পারে, পারিবারিক চর্চার কারণে।
এমতাবস্থায় যে কবি ইমামের ছেলে হয়েও লেখাপড়া ছেড়ে লেটোর দলে ভিড়ল, আবার ফিরে এসে মিলিটারিতে যোগ দিল, লেখাপড়াও শেষ করল, সেখান থেকে অভাবিতভাবে কবি হয়ে উঠল, ইসলাম ছেড়ে কালিসাধনার দিকে এল, বিবিকে তালাক দিয়ে হিন্দু রমণীকে বিবাহ করে উভয় সম্প্রদায়ের বিরাগভাজন হল, যার মাথায় যাত্রাদলের অধিকারীর মতো বাবরি চুল, যার গলায় উদাত্ত গান, যে লোকটা বলেছিল ‘অশিক্ষিত বাঙালি লিখতে পড়তে জানে না, সে গান বোঝে’, রাজনৈতিক দলগুলোর চেয়ে যে কবিকে ব্রিটিশ সরকার ভয় পেত, যার অনশন ব্রিটিশকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল, যার বইয়ের নাম ‘বিষের বাঁশি’ ‘অগ্নিবীণা’ ‘ছায়ানট’ ‘সাম্যবাদী’ ‘সর্বহারা’, সম্পাদিত পত্রিকার নাম ‘ধূমকেতু’, উপন্যাসের নাম ‘মৃত্যুক্ষুধা’, যে লোকটা লন্ডন বা প্যারিস থেকে কবিতার অনুপ্রেরণা নেয় না বরং আরব আর পারস্য থেকে নেয়, যে লোকটা অনায়াসে বলে মৃত্যুর পরে তার লাশ যেন লাল পানি দিয়ে ধুইয়ে দেওয়া হয়, সেই আমলে হিন্দুর মেয়েকে বিবাহ করে, কালীসাধনা করে, আগ্নেয়গিরির মতো সেই লোকটাকে গত পঞ্চাশ বছরের হতমান হৃতসর্বস্ব গামছা পরা বাঙালি কী করে গ্রহণ করবে? অশুভ দেবতার মতো তার মূর্তিই পুজো করতে পারে, তার বেশি নয়। অথবা সে গামছা ছেড়ে তোয়ালে পরবে, বার্গার খাবে, এবং ভিনদেশি সাহিত্যের কবিদের বইয়ের মলাট সোশ্যাল নেটওয়ার্কে পোস্ট করবে, নজরুল তার কাছে একটা গ্রাম্য ব্যাপার, এবং বর্জনীয়।
আর, আমরা যারা কবিতা নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই? এই  ২০১৯ খৃস্টাব্দে এসেও বলতে হয় ‘কবিতা কী নয়’ সেটা আমরা শিখেছি ‘কবিতা’ পত্রিকার সম্পাদক বুদ্ধদেব বসুর (নভেম্বর ৩০, ১৯০৮- মার্চ ১৮, ১৯৭৪) কাছেই, কখনও বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে সহমত হয়ে, কখনও নিজ-নিজ সংস্কারে তাঁর কথার মৃদুমন্দ বিরোধিতা করেই আমাদের কবিতাচর্চা চলে, এবং সেটা যে আমরা সর্বদা সচেতন হয়ে করি, এমন নয়। তিরিশের দশকের নেতৃস্থানীয় কবিদের প্রায় সবাই স্থায়ী বা অস্থায়ী অধ্যাপক ছিলেন, বিশেষ করে ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপকএঁরা জানতেন একটা প্রজন্মের মধ্যে কীভাবে একটি বিশেষ চিন্তা বা বিশেষ চেতনাকে এমনভাবে সঞ্চারিত করা যায় যে তা ধারাবাহিক হবে। আমার তো এমনও সন্দেহ হয়, তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার এই তরুণ কবিদের পছন্দই করত।
ব্রিটিশ কোনোদিনই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নামক মহান জিনিয়াসটিকে তার উপনিবেশের বুকে নিয়ে স্বস্তিতে ছিল না। যারা বলে ব্রিটিশকে খুশি করতে ফরমায়েস অনুসারে না কি রবীন্দ্রনাথ ‘চার অধ্যায়’ লিখেছিলেন, তারা মূর্খের স্বর্গে বাস করে। ‘চার অধ্যায়’ ব্রিটিশ আমলের তথাকথিত বিপ্লবী আন্দোলন তো বটেই সত্তরের নকশাল আন্দোলন বা হালের মাওবাদী আন্দোলনের প্রেক্ষিতেও একটি অপ্রিয় আয়না। বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম তো ব্রিটিশের গলার কাঁটা ছিলেন। তৎকালীন পলিটিকাল দলগুলোও এই ভুঁইফোঁড় কবিকে নিয়ে যথেষ্ট অসন্তুষ্ট ছিল। সেটা বোঝা যায় যখন নজরুল ইসলাম লাগাতার অনশন করছেন, বাংলার পলিটিকাল দলবল অনেক দিন অবধি চুপচাপ তামাশা দেখেছে। যাঁরা নিজেরাই একেকটি দেশজোড়া পলিটিকাল পার্টির সমকক্ষ, এমন বিপজ্জনক দুই কবিকে প্রশমিত করার ব্যবস্থা একটি সরকারকে করতেই হয়। গনগনে পলিটিকাল চেতনার বদলে বাংলা কবিতায় যদি আন্তর্জাতিক মেধার সঞ্চার হয়, আগুন ঝরানো অসন্তোষ ছড়ানো গোলমেলে কবিরা যুবসমাজে একটু ব্যাকডেটেড আর কোণঠাসা হয়ে যান, ব্রিটিশের এর বেশি চাওয়ার কী থাকতে পারত!
১৯৩০-এর পরে উদিত এই তরুণ কবিরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মিক-আধ্যাত্মিক এবং নজরুলের মানসিক ও শারীরিক প্রভাবকে শিক্ষিত তরুণ সমাজে প্রশমিত করবেন, এমন মতলব কি ব্রিটিশের মনের কোনো কোণেই ছিল না? মনে রাখতে হবে, কলকাতা কিন্তু তখনও ব্রিটিশের পৃথিবীতে লন্ডনের পরের জায়গায় বিরাজ করছে। কলকাতা তখন সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় শহর, সারা জগত তার নাম জানে। তিরিশের দশকের কবিরা কি খানিকটা সেফটি ভালভ হিসেবেই কাজ করেননি, যখন এই সমাজের শিক্ষিত অংশটি টেলিভিশন বা সিনেমার দ্বারা নয়, সাহিত্যের দ্বারাই নিজের অভিমুখ খুঁজত, কান পেতে থাকত রবীন্দ্রনাথ কী বলছেন, নজরুল কী গাইছেন? সন্দেহভাজন বিশিষ্ট বাঙালির তালিকায় তখন খোদ রবীন্দ্রনাথেরও নাম, কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে কলকাতা ত্যাগ যেন রবীন্দ্রনাথ না করেন, এমন আদেশ জারি হয়েছে। আর নজরুল? নজরুল ইসলামের যতগুলো কাব্যগ্রন্থ নিষিদ্ধ আর বাজেয়াপ্ত হয়েছে যে, সারা দুনিয়ায় অন্য কোনো লেখকের বই হয়েছে কি না সন্দেহ আছে।
আজ বিশেষ করে বাংলাদেশে নজরুল ইসলামকে হাতিয়ার করে রবীন্দ্রনাথকে হেয় করার একটা সাম্প্রদায়িক প্রবণতা মাথাচাড়া দিয়েছে। রবীন্দ্রনাথকে হিন্দু আর নজরুলকে মুসলমান দাঁড় করিয়ে যদি কিছু লোক খিস্তিখেউড় করে, কোনো ভাষার পক্ষে সেটার চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক কিছু হয় না। বাংলা কবিতায় রবীন্দ্রনাথের পরিপূরক কোনো কবি যদি থাকেন তিনি নজরুল ইসলাম। রবীন্দ্রনাথের পরিপূরক কোনোভাবেই জীবনানন্দ দাশ নন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের তুলনার কোনো জায়গাই নেই, এটাও উল্লেখ্য। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তুলনা করতে হলে গ্যেটে বা তলস্তয় বা গালিবের করা যায়। বাংলাভাষার কোনো কবির সঙ্গেই নয়। কিন্তু, পরিপূরকের প্রসঙ্গটা স্বতন্ত্র। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঠিক সেভাবেই বাঙালি এবং ভারতীয় সমাজে একজন ট্রাবল-মেকার ছিলেন যেমন রাশিয়ায় ছিলেন দাস্তাইয়েভস্কি বা তলস্তয়। রবীন্দ্রনাথ যে কবিতা লিখতেন সেই কবিতার রস একটা বিদ্রোহকে উসকে দিতে পারত না। দেশপ্রেমের সহায়ক হতে পারত। কিন্তু রক্তপাতের উন্মাদনা জাগাতে পারত না। রবীন্দ্রনাথের পক্ষে রক্তপাতের আর আগুন জ্বালার পলিটিক্সকে উসকে দেওয়া তো দূরস্ত, সমর্থন করাও অসম্ভব ছিল। উপনিষদ-আশ্রিত রবীন্দ্রনাথ ছিলেন আত্মার কবি। আরব্য ঐতিহ্য ও কালীসাধনা আত্মীকৃত করা এবং নজরুল ছিলেন মন আর শরীরের কবিরক্ত কীভাবে গরম হয়, ক্রোধে অথবা কামে, নজরুল সবচেয়ে ভাল জানতেন। বাঙালির তার বিপ্লবী চেতনার জাগরণের জন্য একজন নজরুলকে প্রয়োজন ছিল। সেটা বোঝা যায় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিপ্লবী নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর এই ‘লোককবি’-র প্রতি, এই people’s poet-এর প্রতি অকুণ্ঠ অনুরাগ ও শ্রদ্ধা দেখেই। এবং, ব্রিটিশের তাঁর প্রতি ত্রাস দেখে।
এখানেই আবার ত্রিশের কবিদের মনে পড়ে। সেই কলকাতায় বসে তিরিশের দশকের শিক্ষিত মেধাবী আন্তর্জাতিক সাহিত্য-সচেতন কবিদের মধ্যে তৎকালীন ব্রিটিশ রাজের ‘বিরুদ্ধে’ একটাও জ্বলন্ত কবিতা কেউ লিখেছেন কি, যেটার কারণে তাঁদের জেল হতে পারত বা চাকরি যেতে পারত? এটা তাঁদের প্রতি কোনো নালিশ নয়। কবি সেটাই লিখবেন যেটা তাঁর প্রাণ চায়। কবিতার দাবিই সবার আগে। কিন্তু একাধিক কবির সামাজিক অবস্থান অনেক সময় এক বা একাধিক কবির সামাজিক সুবিধা বা অসুবিধার কারণ হয়েই ওঠে। তিরিশের দশকের কবিদের কবিতায় দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী ও পরবর্তী মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত নাগরিক সমাজের তিক্ত হতাশ ক্ষুধার্ত ছবি ফুটে ওঠে, সেই ছবি ব্রিটিশের পক্ষে ততটা অস্বস্তিকর নয়, যতটা বাঙালির নিজের পক্ষে। সমর সেনের কবিতাও এমনকি এ-ব্যাপারে ব্যতিক্রম ছিল নারবীন্দ্রনাথ বা নজরুলের কবিতার মতো কোনো প্রত্যক্ষ পলিটিকাল গুরুত্ব বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথ দত্তদের কবিতার ছিল না। ব্রিটিশ শাসন যে একটা অসহ্য ব্যাপার, সেটা এঁরা সরাসরি একটা লাইনেও বলেননি। বরং সযত্নে বাংলা কবিতা থেকে মুছে ফেলতে চেয়েছেন কবিতার যতটুকু গ্রামীন স্বভাব।
এবং আমরা আমাদের ডিএনএন-তে তিরিশের কবিদের ধারণ করেছি, জেনে বা না জেনেই। বুদ্ধদেব বসুর পূর্ববর্তী স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বুদ্ধদেবের সমকালীন জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেবের পরবর্তী সুনীল-শক্তি-বিনয়-ভাস্করদের কবিতা আমরা যেভাবে আত্মীকৃত করেছি, চুষে চিবিয়ে ছিবড়ে করেছি, তাঁদের কবিতা-বিষয়ক ভাবনা, বা কবিতা নিয়ে লেখা প্রবন্ধ আমাদের রক্তস্রোতে সেভাবে মেশেনিখাদ্যের মধ্য দিয়ে যে রস রক্তে আসে, তার চেয়ে অনেক কার্যকর হয় ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে রক্তে পৌঁছে দেওয়া রস। এক্ষেত্রে রস না বলে রসের বোধ বলা যেতে পারে। কবিতা কাকে বলে, আমরা সেটা তিরিশের কবিদের কাছেই শিখেছি, আমরা, অর্থাৎ যারা কবিতা চর্চা করি। সাধারণ মানুষ, অর্থাৎ জনসাধারণ কিন্তু সেটাকে কবিতা বলে জানে না। সাধারণ মানুষ সমর সেন, বিষ্ণু দে বা সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কবিতা কোনোদিনই পড়েনি, পড়বে বলেও মনে হয় না। তারা শার্দুলবিক্রীড়িত বা মন্দাক্রান্তা ছন্দ কাকে বলে কোনোদিনই জানতে পারবে না, কিন্তু তারা নজরুল ইসলামকে পড়ে। সুকান্ত ভট্টাচার্যকে পড়ে। আজও। এটা তিক্ত সত্য। এমনকি, সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে কি জনসাধারণ খুব পড়ে, যদিও তিনি ‘বৌদ্ধ’ নন? প্রেমেন্দ্র মিত্রকে তাঁর প্রথম জীবনের জনপ্রিয়তা থেকে সুকৌশলে ভ্রষ্ট করা হয়েছিল, তিনি আজ শুধুই ছোটগল্পকার আর ঘনাদার লেখক হিসাবে পরিচিত। অবিশ্যি আজ জনসাধারণ কবিতা পড়ে কোথায়! প্রতাপশালী প্রতিষ্ঠানের ডাকসাইটে কবির বইও তো ১০০০-১২০০ ছাপা হয়। বাঙালির সংখ্যা আজ কত কোটি একবার ভাবুন।
বুদ্ধদেব বসুর কবিতা-ভাবনার যে উত্তরাধিকার, সেটা একটা আবহাওয়ায় পরিণত হয়েছে, যেখানে মধ্যপ্রাচ্যের মরু বা বাঙালি পল্লীর দিকে তাকিয়ে থাকা কবিরা খুব সহজে শ্বাস নিতে পারেন না। বিষণ্ণ বা প্রসন্ন নাগরিকতা সেখানে অভ্রান্ত শর্ত। বিশেষ করে ওরিয়েন্টাল নাগরিকতা। একজন বাঙালি কবি সেখানে একজন আমেরিকান-ইউরোপীয় কবির আইসোটোপ। সেখানে বদল্যের, হ্যেল্ডারলিন, গ্যেটে, রিলকে, কালিদাস, পাস্তেরনাক চিরজীবী, কিন্তু একজন নবীন চন্দ্র সেন বা জসিমউদ্দীন বা যতীন্দ্রমোহন বাগচী সেখানে প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীর মতোই অবান্তর হয়ে পড়েন, এবং দ্রুত অপসারিত হন। অসংস্কৃত কোনো কিছুরই স্থান সেখানে নেই, তা সে যদি আবেগও হয়, তাকে ফিল্টার করতে হবে, তার স্বতঃউৎসারিত হওয়া চলবে না।  ‘কবিতা’ পত্রিকায় লেখা ছাপা না হলে, ‘কবিতা ভবন’-এর কড়া একবারও না নাড়ালে তখন কবি হিসেবে জাতেই ওঠা যেত না। একটা প্রতাপশালী পত্রিকা যখন প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে, তার সম্পাদকের মর্জি কবি-লেখকদের জানতে হয়, সুযোগ পেতে হলে তাঁর মর্জি মানতেও হয়। একরকমের দীক্ষা হয়েই যায়।
এই ‘বৌদ্ধ’ আবহাওয়ায় কবিতার মধ্যে ‘নীরসতা’ নিন্দনীয়, যেমন সেই নিন্দা বুদ্ধদেবের কলম থেকেই ভোগ করতে হয়েছে বুদ্ধদেবেরই প্রিয় বাঙালি কবি জীবনানন্দ দাশের মধ্য ও শেষ পর্বের কবিতাকে, কারণ জীবনানন্দের পরবর্তী কবিতা বুদ্ধদেবের পছন্দসইরকমের যথেষ্ট ‘সরস’ ছিল না। জীবনানন্দ যখন পাশ্চাত্য কবিদের অনুসরণ ও অনুকরণ সম্পূর্ণ বন্ধ করে নিজের এক আশ্চর্য শৈলীর দিকে গেলেন, যেখানে তাঁর ব্যক্তিজীবন, তাঁর সমকাল আর মানুষের ইতিহাস একসঙ্গে কথা বলছে, সেই কবিতাকে করুণা করলেন বুদ্ধদেব। ছন্দ-মিল অবশ্য পালনীয়। বদল্যেরের গদ্যকবিতাগুলি অনুবাদ করতে গিয়েও বুদ্ধদেব বসু ছন্দ এবং মিলের অবতারণা করেছেন নিজ মুদ্রাদোষে। একই সঙ্গে কবিতার মধ্যে বাঁধভাঙা জলোচ্ছ্বাসও অবশ্যই নিবৃত্ত করতে হবে কবিকেএবং, সেই কবির কবিতা অবশ্যই জনসাধারণের ভাল লাগার পাল্লায় আসা চলবে না। এই শর্তে ফেঁসে গেলেন নজরুল ইসলাম। আত্মপক্ষ যে সমর্থন করবেন সেই উপায়ও তো তাঁর নেই, কারণ তখন নজরুল রুদ্ধবাক্‌। অবিশ্যি আত্মপক্ষ সমর্থন তিনি নাও করতে পারতেন, যেমন মোহিতলাল মজুমদারের বেলায় করেননি।
তিরিশের কবিদের পরেই পঞ্চাশের কবিদের মধ্যে বুদ্ধদেব বসু এবং তাঁর বন্ধুবান্ধবদের এই মানসিকতা সঞ্চারিত হয়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন কবিরা চলে যান সেই প্রাতিষ্ঠানিক সফলতার দিকে, যেখানে কবি হিসেবে মান্যতা পাওয়ার জন্য জনতার দরবারে পরীক্ষা দিতে হয় না, কবিকে বহন করে নিয়ে যায় শক্তিশালী বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, প্রতিষ্ঠানই কবিকে তৈরি করে এবং প্রতিষ্ঠিত করে দেয় জনমানসে নিজেদের জোরে অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে জনগণের মধ্যে কবিতা লিখে নজরুল ইসলামের তুল্য জনপ্রিয় হওয়ার কোনো ব্যক্তিগত চেষ্টা পঞ্চাশের কবিদের ছিল না। সেটার জন্য তাঁদের কেউ কেউ উপন্যাসকে হাতিয়ার করেছিলেন। পঞ্চাশের আরেকদল কবি আলোক সরকার-অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের নেতৃত্বে চলে যান কবিতার সেই শুদ্ধতম রূপের দিকে যেখানে কবিতা লেখাই কবিতার একমাত্র আনন্দ, ঘামে ভেজা ধুলোমাখা পাঠকের যেখানে সেই অর্থে খুব একটা মূল্যই নেই। এই দুটো পথের মাঝখানে দাঁড়িয়ে কবিতার পাঠক কিন্তু বেকুব হয়ে গেল। তার হাতে এই দুটো পথেরই রোডম্যাপ ছিল না। একটা গাড়িও তাকে নজরুল ইসলামের জগত অবধি লিফট দিল না।
তিরিশ থেকে পঞ্চাশের দশক হয়ে ক্রমেই গড়িয়ে আসা এই মানসিকতার জন্য কবিতা আজও গণ-বিচ্ছিন্ন এক অবস্থানে রয়েছে। কবিরা মানুষকে নিয়ে ভাবে নামানুষ কবিকে নিয়ে মাথা ঘামায় না। উভয়কে বিদ্রুপ করে উভয়ের চলে। সেখানে নজরুল ইসলামকে রামমোহন বা বিদ্যাসাগরের মতোই পথের পাশে বা প্রতিষ্ঠানের মুখে মূর্তিমান মনীষী বানিয়ে দায় সারা হয়েছে। হয়ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পুরস্কার না পেলে এই ‘বৌদ্ধ’ আবহাওয়ায় তিনিও একজন মূর্তিমান মনীষী হয়েই থাকতেন, কিন্তু তাঁর কবি পরিচয় হাতছাড়া হয়ে যেত। বুদ্ধদেব বসুকে রবীন্দ্রনাথের জন্য বিশেষ জায়গা বানাতে হয়েছিল নিজের পৃথিবীতে, প্রায় গ্যেটের সমান এক জায়গারবীন্দ্রনাথের বিপুল আন্তর্জাতিক গুরুত্ব থাকার ফলেই সেটা করতে হয়েছিল তাঁকে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে গর্বিত না হওয়ার অবকাশ বুদ্ধদেব বসু দিয়ে উঠতে পারেননি নিজেকে, কিংবা, রবীন্দ্রনাথই সেই সুযোগ বুদ্ধদেবের সামনে রাখেননি।
নজরুলের কবিতা সম্পর্কে প্রথম জীবনে বুদ্ধদেব বসুর আবেগ ছিল, সেটা তাঁর লেখা থেকেই জানা যায়, কিন্তু পরবর্তী জীবনে সেই আবেগকে তিনি নিজের চিন্তার তলায় চাপা দেন, এবং নজরুলের কবিতাচর্চাকে প্রতিভাবান শিশুর খেলা সাব্যস্ত করেন। নজরুল যে ঠিকঠাক ‘কবি’ নন, এই মানসিকতা তো আগাগোড়াই ছিল, সেটা বোঝা যায় যখন তাঁর ‘বসন্ত’ গীতিনাট্য নজরুলকে উৎসর্গ করে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকেই কৈফিয়ত দিয়ে বোঝাতে হয়েছিল নজরুল একজন কবি, তা সে যতই তাঁর কবিতার মধ্যে অসির ঝনৎকার থাকুক। কিন্তু, সেই যে বুদ্ধদেব বসু নজরুলের কবিতাকে ছেলেখেলা বলে দিলেন, তার আর উপশম রইল না, সেটাই পণ্ডিতদের মধ্যে রয়ে গেল। এই সত্যটাও চাপা পড়ে গেল যে, স্বয়ং জীবনানন্দ দাশের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরা পালক’-এ নজরুল ইসলামের সুস্পষ্ট প্রভাব ছিল  
সেই ট্র্যাডিশন আজও চলছে। আজও বাংলা কবিতার লোকেরা যে কবির কবিতাকে হজম করতে পারেন না, তাঁকে ‘অকবি’ আর তাঁর লেখাকে ‘অকবিতা’ বা ‘ছেলেখেলা’ বলে চালিয়ে দ্যান, ট্যাগটা দিব্যি জ্বলজ্বল করতে থাকে পাগলা গারদের নম্বরের মতোকিন্তু, নজরুল ইসলামকে মুছে দেওয়া যায়নি। তাঁর জনপ্রিয়তা আজ বাঙালির রক্তে বাঙালির পরিবর্তনেরই সমানুপাতিক। আজ যে সন্ধেবেলায় উত্তর কলকাতা বা মেদিনীপুর বা বহরমপুরের কোনো পাড়ার শান্ত গলিতে যেতে যেতে আপনি হারমোনিয়ামে নজরুল গীতি শুনতে পাবেন না কোনো কিশোরীর অনুচ্চ কন্ঠে, সেই প্রথা যে মিলিয়ে যাচ্ছে, শোনা যাচ্ছে বাংলা সিরিয়ালের সংলাপ, সেটা নজরুলগীতির দুর্বলতা নয়, বাঙালি আজ গান শেখাচ্ছে না আর মেয়েকে সেভাবে। ওটা অপ্রয়োজনীয় হয়ে যাচ্ছে। অনেকের কাছেই আজ হয়ত ‘সঞ্চিতা’-র কাগুজে সংস্করণ নেই, আছে ই-বুক। কিন্তু তিনি আছেন। তিনি থাকবেন। আজ থেকে হাজার বছর পরেও মাটির তলা থেকে তাঁর মূর্তি আবিষ্কৃত হবে, তখন সেই মূর্তির দিকে তাকিয়ে কেউ আর তিনি মোল্লা না মালাউন, কবি না অকবি এই তর্কে যাবে না। নজরুল ইসলামের ইতিহাস তাঁর মূর্তিকে অতিক্রম করে আরো সহস্র বছর অনায়াসেই প্রবাহিত হবে, কিংবা আরো বেশি।  

                                                                                              (প্রকাশিত- 'কবিতীর্থ')


No comments:

Post a Comment