'অনুপম মুখোপাধ্যায়ের কবিতা ২০১৮-১৯' সম্পর্কে সমকালীন কবিলেখকদের আলোচনা



‘অনুপম মুখোপাধ্যায়ের কবিতা ২০১৮-১৯’ প্রকাশিত হয়েছে ‘বাক্‌ প্রকাশনী’ থেকে। বইটি আত্মপ্রকাশ করে শারদীয় পুজোর ঠিক আগে। এবং পুজোর কয়েকদিন পরেই প্রথম মুদ্রণ ফুরিয়ে যায়। এখন দ্বিতীয় মুদ্রণ সম্পূর্ণ হয়ে প্রস্তুত হয়েছে। এখানে আমরা এই বইটি সম্পর্কে এই সময়ের কয়েকজন কবি ও লেখকের মতামত তুলে ধরলাম। এই মতামতগুলি পাওয়া গেছে ফেসবুকে তাঁদের বিভিন্ন পোস্টে। এখানে একসঙ্গে দেওয়া হল। 
 

কবি বিশ্বজিৎ অধিকারী মেদিনীপুরের 'ভূর্জপত্র' থেকে বইটি সংগ্রহ করেছেন এবং লিখছেন-

'"কিছু যেমন বিস্কুট হয় খাওয়ার আগে
ইচ্ছে করে না
খেতে খেতে ভাল লেগে যায়"
এই অংশ অনুপমের একটি কবিতার, যা তাঁর নতুন বইতে সংকলিত হয়েছে, এবং যা এর আগেই পড়তে পাওয়া গেছে তাঁরই একটি উপন্যাসে। যাই হোক, নতুন কবিতার বইটি পাঠ করতে করতে এই স্তবকটির কথাই বারবার মনে আসে। এবং এটাই আপাতত আমার বইটি সম্পর্কে প্রাথমিক অনুভব। আমি এই মুহূর্তে কার্যত একটি কুয়াশার কুকুর এবং অনুপমের কবিতা আমার সেই বিস্কুট।
যারা অনুপমের প্রকৃত মুখশ্রী দেখতে চান তারা প্রাবন্ধিক অনুপমকে লক্ষ্য করুন, কেননা কবি অনুপম সর্বদাই একটি নড়বড়ে বেমাপের মুখোশ পরে থাকেন।
ভরসার কথা, সেই মুখোশটি এবার বেশ বিবর্ণ হয়ে এসেছে। যারা লেখালেখিতে কিছুটা বিপ্লবী গোছের তাদের টেক্সট সাধারণের কাছে প্রায়ই খানিকটা ভীতিপ্রদ হয়ে থাকে। কিন্তু দায়িত্ব নিয়ে বলছি, বর্তমান এই বইটিতে ঝড়ঝঞ্ঝা প্লাবনের শেষে একটি উর্বর নদীচরের দেখা পাবেন পাঠকেরা। পুনরাধুনিকে গুলি মারুন, সমস্ত দেখনদারির খোলস খুলে গিয়ে আবহমান বাংলা কবিতার লাবণ্যময় ত্বক এবার ক্রমে প্রকাশিত হচ্ছে। অনুপম মুখে যত গাম্ভীর্য দেখাক, সে আসলে একজন অত্যন্ত মায়াবী যুবক। অনুপমের জন্য আমাদের অফুরন্ত শুভেচ্ছা।'


___________________________________________________________________________________________________________


কৃষ্ণনগর শহরের গ্রন্থবিপণী 'সংকলন' থেকে কবি সোনালী চক্রবর্তী প্রথম এই বইটি কিনেছেন। অতএব, উক্ত শহরে তিনিই এই বইয়ের প্রথম অফিসিয়াল পাঠক। সোনালী লিখছেন-
.
"যেখানে বন নেই সেখানে আমার অস্থিরতা/শিকারকাহিনির আয়না ভেঙে আছে
ভালবেসেছির চেয়ে ভালবাসতে চেয়েছিলাম/এই কথাটা কবিতায় বেশি কাজে লাগে"
কী প্রয়োজন এই কবিতা প্রণেতার পূর্ব পরিচয় জানার?কী প্রয়োজন কোন ইতিহাস পেরিয়ে তিনি কোন অমরত্বের দিকে এগোচ্ছেন সেই জমি জরিপের? যেভাবে কর্ডেলিয়া পিতা লিয়ারকে তাদের সম্পর্কের সূত্র ব্যাখ্যা করেছিলেন আবেগ বর্জিত হয়ে,এই বই-এর নাম থেকে শুরু করে যতিচিন্হহীন সবকটি এবং প্রতিটিতে অবিকল সেভাবেই যাবতীয় বাহুল্যের গ্রন্থি মোচন করে শুধু অস্তিত্ব থেকে গেছে এক দৃঢ় সত্যের,যার নাম 'কবিতা'।অনুপম এই বইতে অতিক্রম করেছেন তাঁর পুনরাধুনিক তত্ব,তাঁর পূর্ব গ্রন্থগুলির কাব্য গঠন প্রণালী, এমনকি সম্ভবত: তাঁর নিজস্ব ছায়াকেও। যিনি বলেন "ব্রহ্ম,প্রেম আর কবিতাকে জানতে নেই,জানলে আর ফিরে আসা যায়না,কবিকে ফিরতে হয়,বার বার", তিনিই বোধহয় পারেন "কবিতা 2018-19" লিখতে যেখানে নিজেকে ভেঙে চুরে এমন কবিতাদের তিনি দৃশ্যমানতা দেন,পাঠক পৌঁছে যান কল্প আর বাস্তবের সীমা নিয়ে দ্বন্দ্বে পড়ে যেতে।
"রাজনীতি করা লোক মাঝরাতে ফিরে/মেয়েকে কি বলে তার রাক্ষসের কথা"
অথবা
"দেবতার মৃদু জিভ মাংসের কণিকা/লকলক করে দেবী চেরাটুকু বোঝে"
এই বই-এর পাঠ প্রতিক্রিয়া নিজের ভিতরে ঠাহর করতে গেলেও পাঠককে স্বয়ং জল হতে হবে,হয়তো বা তার তৃষ্ণা কাকে বলে প্রথমবার জানার ইচ্ছেও হতে পারে।কবিতা যে নেশার তীব্রতায় মদকে কয়েকশো গোল অবলীলাক্রমে দিয়ে দেয় যে কোন মুহুর্তে তা নিয়ে তার সন্দেহের নিরসন ঘটাও অসম্ভব কিছুই নয়।প্রতিটা লাইনে অন্তর্লীন বিভৎস সব অহং,আক্ষেপ,অভিমান আর আলো অথচ কী অসীম নিয়ন্ত্রণ তার কাব্যরূপে বহি:প্রকাশে।
"চাঁদে কিছুদিন থাকি ভাঙা কিরঘিজ/এত গুঁড়ো এ জীবনে গোটানো যাবে না"
অনুপম মুখোপাধ্যায়,আপনি 'বাক্' পরিচালক,সমাজ ব্যাখ্যাতা,পশ্চিমবঙ্গের একমাত্র ইন্টেলেকচুয়াল যেই-ই হন,শুধুমাত্র কবিতার একজন সামান্য পাঠক পরিচয়ে আমি "কবিতা 2018-19"-এর রচয়িতা কবি হিসেবে আপনাকে অসীম কৃতজ্ঞতা জানালাম।এভাবেও যে অভেদ্য দূরত্ব গড়ে দেওয়া যায় 'কোবিতা' থেকে কবিতার,নতজানু হয়ে শিখতে হলো।অভিযোগটা আপনার সৃষ্টি ধার করেই করছি-
"ময়ূর কেবল নাচে/ময়ূরী নাচে না/এ কোন নিয়ম হল/বসন্তসেনা"
.................................................................
সোনালী এটুকুই লিখেছেন। পুনরাধুনিক তত্ত্বকে অতিক্রম করার বিষয়ে এটা বলা যায় যে, পুনরাধুনিকে অতিক্রমণ একটা বড় ব্যাপার, এবং কবির ক্রমবিবর্তনও, তাই পুনরাধুনিক আদৌ কোনো বাঁধাধরা তত্ত্বই নয়।

_________________________________________________________________________________________________________

কবি এবং 'কবিতা আশ্রম'-এর অন্যতম প্রাণপুরুষ অমিত সাহা লিখছেন-

জগতের প্রতিটি উপাদানের অন্তরেই নিহিত থাকে সত্য। এই সত্যটাকেই খুঁজে চলেন একজন ঋষি, একজন বিজ্ঞানী, একজন দার্শনিক, একজন কবি তাঁদের নিজের মতো করে। সম্প্রতি পড়ছিলাম অনুপম মুখোপাধ্যায়ের 'কবিতা ২০১৮-১৯' পড়তে পড়তে এটাই ভাবছিলাম।

অনুপম দা'র সব লেখাই যে ভালোলাগে তা নয়। কিন্তু ওঁর ধারাটাকে সম্মান করি। এই বই যেন আবার নতুন অনুপমকে চেনাল। বই থেকে একটি কবিতা পড়ুন।

ক্ষত
অনুপম মুখোপাধ্যায়

শুকনাে পাতার গায়ে লেগে আছে ফেলে আসা শাখাটার বাঁক
যে মাটিকে জীবনে চেনেনি
সেই মাটির ভাষা পেয়েছে
খসার আগে কেন তার বুক ঢালু হল না

গুলির আওয়াজ থেকে বন্দুকের ক্রোধ কেউ বুঝতে পারে কি

পশুদের তেষ্টা আর পায়ের শধ নিয়ে আছি
জীবনের কাটা অংশগুলােকে মাটিতে পুঁতেছি
যদি তাদের থেকে কিছু সবুজ পাতা হয়
রক্তাক্ত বাঁকগুলাে হাসে

তােমার মিসড‌্ কলটাকে হাত থেকে ফসকে যাওয়া বিকার মনে হল

দীর্ঘ ভগ্নাংশ নিজের মুখে চাই
তােমার ক্ষত
আমার মুখ

আমার গােটা শরীর আমার মুখ হয়ে গেল
 
 
_________________________________________________________________________


কবি শানু চৌধুরী ফেসবুকে লিখছে-

 'অনুপম মুখোপাধ্যায়ের কবিতা ২০১৮-১৯' বইয়ের তথাকথিত কোনো নাম নেই, কেন? এর কারণ আমার মনে হয় কবিতা আজ যেহেতু দাঁড়িয়ে আছে ' Rawness' শব্দটায় সেখানে চটকদারি নামকরণের আর জায়গা নেই। আজ আর কবিতার বিশ্বাস নেই প্রগতি কল্পনায়। নিজের কথাগুলো বলে যাওয়াই এখন হতে পারে দ্বিধাহীন ভাবে কবিতার কাজ। একজন কালো মানুষের গান যেমন হয়! এখনও পর্যন্ত বইটা হাতে পাওয়ার পর যেটুকু পড়েছি বইটির মধ্যে আমি পেয়েছি অনন্ত প্রতিচ্ছবি, অনায়াস যাতায়াতে বুঝতে পেরেছি রচনারীতির গুণ নয় বরং গুণকে তাচ্ছিল্য করেছে অনুপম! 'Greek comedy'- র ক্ষেত্রে 'Norwood' -এর কথা ধার যেমন বলা যায় ' Force may be defined as exaggerated comedy; its problem unlikely and absured' এই কবিতার বইটির ক্ষেত্রেও যেন এই সমবল প্রযোজ্য। আসলে সময়ের অসংগতিকেই দেখানো হচ্ছে এক তীক্ষ্ণ প্রহসনের মোড়কে। 'রুটিগাছ' থেকে শুরু করে এখনো অবধি 'মাঝি রে' -তে এসে আমার মনে হয়েছে কোথায় অতিরঞ্জন? কোথায় বাগাড়ম্বর? একটুও নেই। অনুপম যেন দ্বন্দ্ব, সংকট ও মীমাংসার ভিতরে স্বার্থান্ধ, উচ্চাকাঙ্খী সিনিকদের চোখে এঁকে দিচ্ছে নদীর বহতা..."

__________________________________________________________________________________________________________


রামকৃষ্ণ প্রধান লিখছেন- 

প্রায় দুই মাস হলো বইটি এসেছে। আমি পড়িনি, কারণ মানসিক প্রস্তুতি ও সময়ের প্রয়োজন। আমি শোকেস সাজানোর জন্য বই ক্রয় করি না। আজ পড়া শেষ করলাম। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভাষা ও তার বিন্যাসের পরিবর্তন ঘটে । সেটাই নিয়ম। সত্তর বা আশির দশকের কবিতার চোখ দিয়ে এই কাব্যগ্রন্থ পড়া সম্ভব নয়। সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে ভিন্ন শৈলীতে এ কাব্য লেখা। যাকে কবি পুনরাধুনিক বলেন। আমার মতো কম লেখাপড়া জানা লোকের ক্ষেত্রে এ কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি লেখার অর্থ উদ্ধার করতে বেশ সময় লেগেছে। মোদ্দা কথা আমার পুঁজি কম তাই বুঝি কম। এই 2020 পর্যন্ত বাংলা ভাষার যে বিবর্তন ঘটেছে তার সটুকুই এই বইতে আছে। বরং এটা বলা যায় যে সামনের বিশ বছরে বাংলা কবিতার যে বিবর্তন ঘটবে সেটা এখনই দেখা যাচ্ছে। প্রথাগত নিয়ম ভেঙেচুরে এক অন্য ধারার জন্ম দিলেন অনুপম -
বরফে মরেছি আমি হরফে মরেছি
নিজেকে মারার সুখ কোন শালা চায়

এ এক চ্যালেঞ্জ বটে । যে নতুন কিছু করবে তাকে তো লোক পাগল বলবেই । চেনা ছকের বাইরে লিখলে পাঠক ছুঁড়ে দেবে এ ভয় নিয়ে কি লেখা যায় নতুনের গান ?
হাইপার পাঠকের ভয়ে
প্রত্যেক কবিতায় লাইন হারাই
শব্দ লিখতে গিয়ে ভিতু হয়ে যাই
মানুষের মতো নদীকে যারা আউটসাইডার বলে তাদের বুকে জেগে আছে পুরুষ পশু , সে পুরুষ চাঁদের আলোয় ভালোবাসা পড়তে পারে না । তবু তো সে এসেছিল নায়কই হতে কিন্তু এ যে কোথাও আগেই লেখা ছিলো-
সব দিতে চায় লেখা শব দিয়ে যায়
মড়া পোড়ানোর ঘ্রাণ যেমন রচনা
সম্পূর্ণ কাব্যগ্রন্থের মধ্যে মাত্র দুটি কবিতায় পূর্ণচ্ছেদের ব্যবহার দেখা যায়। কমা ( , ) চিহ্ন এর ব্যবহার নেই। অথচ এর জন্য কবিতার কোনো ক্ষতি হয়নি ! এক বা দুই এই সংখ্যাগুলোকে ভাষায় না লেখার প্রবণতা দৃষ্টান্তমূলক। এই ২০২০ তে দাঁড়িয়ে এ কবিতাকে অস্বীকার করা যায় না। সমীহ ও ঈর্ষা আদায় করতে সক্ষম এই কাব্যগ্রন্থ। এ কবিতাকে ছিঁড়লে আকাশের মাংস দেখা যায় । জীবনানন্দের পরে কাউকে কবিতার স্রোতের বাইরে এইভাবে যেতে দেখিনি। যেমন এক সময় চিত্রশিল্পে কনুই বা তলপেটে চোখ আঁকা হয়েছে। সেই মনন ও চেতনার খরা কাটিয়ে অনুপম বাংলা কবিতার সমৃদ্ধি ঘটিয়েছেন।
আমি ১টা সেমিকোলনের চেয়েও বেশি
মুগ্ধ হতে শিখেছি
জিনিয়াসরা যেমন নয়
পাগলরা যেমন
এখানে জন্ম হয় বিস্ময়ের, কবির এ ভাবনা আমাকে বাধ্য করে সময়ের দাঁড়িপাল্লায় কিংবদন্তি পিপাসা মাপতে। ঠিক কতটা ? গালিবের মৃত্যু যন্ত্রণা থেকে রবীন্দ্রনাথের ন্যুব্জতা অবধি নাকি রেলব্রিজের নীচে দাঁড়ানো শ্বাশত গাভী থেকে শাঁখারি বাজার পর্যন্ত? বিস্ময়ের ঘোর কাটে না।

সাহিত্যিকের বেঁচে থাকার জন্য পুরস্কার লাগে না, উন্নত মেধার পাঠক লাগে। আমি সে পাঠক নই। কবিও নই । তবু ভেবেছিলাম 'কর্ণ' সাহিত্য অকাদেমি পাবে। 'কর্ণ' ও ' শ্রী কৃষ্ণের শেষ কটা দিন ' নিয়ে একটা দীর্ঘ চিঠি অকাদেমী কতৃপক্ষকে লিখবো ভেবেও লিখিনি । তাঁরা হয়ত ধর্মের নামে মহাভারতের মিথটাকে ভাঙতে চায়না। তাছাড়া আমার মতো পান্তা মুড়ি খাওয়া ঘিলু কি আর সেই উৎকৃষ্ট সাহিত্য বুঝবে ? ওই যে বললাম আমার পুঁজি কম তাই বুঝি কম। এই সময়ে দাঁড়িয়ে নিরপেক্ষ ও সেরা সাহিত্য যে কলম দিয়ে বেরুচ্ছে তার নাম অনুপম। আপনি আমাকে কারোর স্তাবক ভাবলে আমার ছেঁড়া যায়। আমি সময়ের কাছে নিরপেক্ষ এক দলিল রেখে গেলাম।
__________________________________________________________________________________________________________

শতানীক রায় লিখছেন-

"লুকোই ক্রমাগত লুকিয়ে যাই তারপর হারিয়ে যাই। কোথাও জলের আভাস নেই। তুই টিকটিকি হয়ে আমার ঘরে মেঝেতে দেয়ালে ঘুরে বেড়াস। এখন এতদিন পর মনে হয় না কেউ কাউকে ছেড়ে যায়। অনঙ্গ প্রদীপের মতো থেকে যাওয়া। এ নিয়ে কোনো কথাও হয়তো কারো সঙ্গে হয় না মুগ্ধ জ্যোৎস্না থাকে না। তারপর বহু জীবন পেরোনো নদী কীভাবে মনে করিয়ে দেয়। কোথাও জীবন নামে সন্তাপ আর করুণার মতো হওয়া বেঁচে আছে। আঙুলগাছের জীবন। সর্বশেষ কথা। আরও সবকিছু। এই নিয়ে আছির কারবার। থাকা। এই নাটক কিছুতেই থামে না। এর বিপরীতে আরেকটা ডিসকোর্স তৈরি করল অনুপম মুখোপাধ্যায়ের 'কবিতা ২০১৮-১৯' বইটা।"


ইদানীং ফেসবুকে কারো বই সম্পর্কে লিখলেই অনেকের মনেই আলোড়ন ওঠে যে, হয়তো এভাবে সেই লেখক বা কবিকে তৈলমর্দন করছি। তবে ভালোভাবে জেনে রাখা প্রয়োজন আমি কাউকে মর্দন করে নিজের লেখালিখি করি না। আর, আমার পাঠকসত্তা বলেও তো কিছু আছে নাকি! অনুপম মুখোপাধ্যায়ের সাম্প্রতিক কবিতার বই 'অনুপম মুখোপাধ্যায়ের কবিতা ২০১৮-১৯' অনেকদিন হল বইটা পড়েছি। আমার যখন কোনো বই ভালো লাগে আমি তার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যাপন করি। যেমন একটা প্রসঙ্গে বলি, কয়েকদিন হল খেয়ালে খেয়ালে মনে হচ্ছে, আমাদের সবার কবিতাই কোনো না কোনো আড়ষ্ট চেতনায় আক্রান্ত আরকী। যা কিছু বাক্য ভেবেছি আমরা বা লিখছি তার অধিকাংশই হল ব্যক্তিগত জীবনের স্থুল আবেগের প্রতিফলন। ভাবছি, অনেকদিন চুপচাপ থেকে জীবনকে প্রায়োগিক অর্থে দেখার করব। 
 
অনুপমের কবিতা পড়তে পড়তে বুঝতে পারলাম, একটা মানুষ তাঁর দিনের সবকিছুর মধ্যে কীভাবে যেন একা হয়ে পড়ছেন যা কিছু অ্যাক্টিভিটি করছেন তার সবটাই যেন একটা বড়ো জটিল ডিসকোর্সের অংশ। এভাবে ধীরে ধীরে এক বিরল মানুষ তৈরি হতে থাকে যার তৈরি হওয়া কোনোভাবেই তার গোপনতার উন্মোচন নয়। তিনি এমন কিছু বলছেন যার বাক্যগঠনে একটা বিরল ভাষা সৃষ্টির ইঙ্গিত আছে। 'চাঁদ ও এশিয়া' কবিতাটি এরকম:

 
"চাঁদে যে এশিয়া হয় অনুপম শোনো
ঝড় হয় জল হয় দেহে সব হয়


যে কোনো দক্ষিণ দিকে উত্তর দাঁড়ায়
পুব লাগে ভালো লাগে ফুজিয়ামা রোদ 


পৃথিবীর মতো শুধু ঘুরে যাওয়া নয়
মানুষের বাকি আছে পৃথিবীকে খাওয়া


অনেক দেখেছি মুখ আমার মায়ের
চিন নেই জাভা নেই মিল কিছু নেই


এখানে আঙুল শুধু ওখানে যোনিতে
লেবানন বাদ রেখে অনামিকা হল


কিছু স্মৃতি বালিদ্বীপে খোুঁজে না পেলে তুমি
আমি যে সুন্দর হই চেয়ে দেখলে না


বুক থেকে পাড়ে গেছে স্তনের জাপান
সে ছিল অচল তাকে মাদল করেছি


চাঁদে কিছুদিন থাকি ভাঙা কিরঘিজ
অ্যাত গুঁড়ো এ জীবনে গোটানো যাবে না"


অনুপমের যাপনে এক বিচিত্র অস্বীকার কাজ করে। নিজেকে অস্বীকার অথবা ছদ্ম প্রতারণার হিসেব নিকেশকে উপভোগ করা এসব তাঁকে এক শরীরের বিপুলে ঠেলে দেয়। 'জেনেসিস' কবিতাটিও পড়া যাক:
"সে দৌড়ে যাচ্ছে বালিয়াড়ি পেরিয়ে অদৃশ্য নৌকাটির দিকে..."

'আঙুল' কবিতাটির শেষ তিন লাইন কবিতাটিকে মেটাফিজিক্যাল করে তুলেছে। 'নখ কাটা হয়ে গেলে কিছু আঙলে জেগে ওঠে/জোকারের প্রসন্ন মুখ/ব্লেড থেকে খসা তামাশা''আয়ুষ্মতীর পা' কবিতায় সময়ের প্রতিধ্বনি শুনি। 'ক্ষত' কবিতাটি আমার মেটাফিজিক্যাল কবিতা মনে হয়েছে। 'ভূতুরে কবিতা' পড়ে যা মনে হয়েছে: এমন এক দৃষ্টান্ত সামনে এল যার একটা করুণ নিয়তি আছে ক্রমাগত শূন্যতাকে ভরে তোলা আরকী। 'অমর আগাছা', 'মাঝি রে' কবিতা দু'টি এই বইয়ের অন্যতম সৃজন বলে মনে হয়েছ। 'কুয়াশার কুকুর' কবিতা পড়ে মনে হয়েছে তা বাস্তবতাকে দেখাচ্ছে যা এক নিহিলিস্ট দৃষ্টির ফসল। একটা অদ্ভুত লুনাসি আছে যেন। 'ফেরত' কবিতাটির ভেতর অ্যাবসার্ডিটি লক্ষ করেছি। নিজেকে বিচ্ছিন্ন করা। 'দেবী' নামক কবিতাটি পড়া যাক:
 
"সেই মন্দিরে নিয়ে চলো
দেবী যেখানে নিজের
প্রিয় ঘন্টাধ্বনিতে

বাজেন
সেই ঘন্টার রূপ নেই
ধাতু হারানো খনির ছলনা

ধূপ নেই"

এমন বহু কবিতায় খচিত অনুপমের বই। পাঠক সংগ্রহ করুন আর পড়ুন। মানুষকে বিচার না ক'রে তাঁর বই পড়ুন। বইটি প্রকাশ পেয়েছে বাক্ প্রকাশনী থেকে।

_____________________________________________________________________________________________________


দীপ্তেন্দু জানা লিখছেন-

কেন আমার অণ্ডকোষ এ রোদের তেল মেখে শক্ত হল না/ প্রেম থেকে পালালে ভালোবাসাকে সার্কাস মনে হয় " (কবিতার নাম 'আঙ্গুল')

"কেউ কেউ মেয়েদের ঠোঁট অধরের চেয়ে বেশি ভালবাসে /আমি তাদের দলে /পাখি হোক/ সব মেয়ে পাখি হোক" ( কবিতার নাম 'ঠান্ডাখেলা')

"ওভাবে শুয়েছ
যেন বালির চড়ায়
জেলেদের জাল ছড়ানো আছে
কিভাবে শুয়েছ
যেন তোমার উপর ঝুঁকে দাঁড়ালে
জল থেকে গত জন্মের
ব্যথা উঠে আসবে "(কবিতার নাম 'শায়িতা')

প্রেমে ও যৌনতায় লাইনগুলি যেমন অত্যন্ত সাহসী, অকপট, ভানহীন। তেমনি মরমী ও বর্ণময়।
"অনুপম মুখোপাধ্যায়ের কবিতা" এমন একটি সংকলন যার অধিকাংশ কবিতাই স্মার্ট। কবিতা গুলি পড়তে গেলে চোখ পাল্টে নিয়ে পড়া শুরু করতে হয় বা বলা ভালো কবিতা গুলির শব্দশরীরে এতটাই ম্যাগমা বহমান যে গতানুগতিক চোখ পুড়ে যায়। প্রেম-যৌনতা-মন খারাপ -ব্যথা- রক্তপাত -এই সমস্ত অনুভবে জারিত হতে হতে জীবনের বিনিময়ে অর্জিত সত্যকে কবি ছুঁয়ে গেছেন কি অবলীলায়! "মমি খাওয়া ভালো নয়" কবিতার শুরুতেই তিনি উচ্চারণ করেন..... "জীবন এক শান্ত বিশ্বস্ত কুকুর /প্রজনন ঋতুতে ছটফট করে /হাড় না পেলে অভিমান "।কবিতাটির শেষ লাইনগুলিও পরিমিত আবেগমথিত... "মমি খাওয়া ভালো নয়/ কুকুর বুঝেছে /ইতিহাসে তাকালেই যে মন খারাপ লাগে/ জীবন বুঝেছে "।কবিতাটি পড়তে পড়তে সত্যিই জীবনের প্রতি বড্ড মায়া হয়।
"রাত " কবিতায় কবি দেখেছেন.... "রেলব্রিজের নিচে/ শাশ্বত গাভী /রাস্তা খুঁজে না পেয়ে/ ঠায় দাঁড়িয়ে আছে"। সেই শাশ্বত গাভীকে খুঁজতে না আসার দোষ হয়তো কবিও এড়িয়ে যেতে চান না। একদিকে যেমন শাশ্বতে আস্থা, অন্যদিকে তেমন "স্নানঘর ", "তরবারি"র মতো অত্যন্ত সংযত কবিতায় রক্তাক্ত সমসময় উঁকি দিয়ে যায়। অসহায়ের মতো তিনি উচ্চারণ করেন... "রোদ্দুরে তেতেছে তরবারি/ নামিয়ে রাখো নামিয়ে রাখো/ ছ্যাঁকা লাগবে হাতে/ এর বেশি আর কী বলতে পারি"। কবিজীবনকেও আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে ইতিহাস সচেতন হয়ে পড়েন তিনি। তাইতো তিনি সপাটে লেখেন.... "কত শ্রেষ্ঠ কবিতা আগাছা হয়ে আছে"। যাইহোক কাব্যগ্রন্থটি পাঠকের বিপুল সমাদর পাবে অনুপমদার জন্য অন্তরের শুভেচ্ছা রইল।

_______________________________________________________________________________________________________________________


কবি এবং সম্পাদক রণজিৎ অধিকারী 'অনুপম মুখোপাধ্যায়ের কবিতা ২০১৮-১৯' সংগ্রহ করলেন, এবং ফেসবুকে লিখলেন-
"না-বাঁশির কোণ লেগে সুর ছিঁড়ে গ্যাছে"

কবিতার পাঠক আর কবির মধ্যে বন্ধুতা থাকা উচিত না;
সখ্য পাঠের প্রভূত ক্ষতি করে, করেই চলেছে।
তবে আজ থেকে ১৩ বছর আগে অনুপম যখন তাঁর "রোদ ওঠার আগে" বইটিতে লিখে দিলেন: বন্ধু রণজিৎ, চলুন...
তখন আমার কীইবা করার ছিল।
প্রসঙ্গত অনুপমের সঙ্গে আমার বন্ধুতা নেই, একই মঞ্চে দুজনে বিপরীত ভাষণ দিয়েছি। কিন্তু অনুপম-এর কবিতার সঙ্গে আমার যোগ থেকে গেছে।
যাত্রাটি দীর্ঘ--রোদ ওঠা থেকে আজ এই ২০১৮-১৯ এর কবিতা।
আমি এখনো বলি, আপনারা যাঁরা, হ্যাঁ, এখন অনুপম কবিতা পড়ছেন, মতামত দিচ্ছেন সম্প্রতি, তাঁরা ক'জন "রোদ ওঠার আগে" পড়েছেন?
যদি না পড়েন কীভাবে অনুপম জার্নি বুঝবেন?
ঘোষণার মতো করে বলি, রোদ ওঠার আগে আমার সবচেয়ে প্রিয় বই। হ্যাঁ, "রুবারু"র থেকেও "অনুপম%মানুষরা" থেকেও। তবে "অপরাজিতা কিন্তু নামকরণে হেরে যায়" অনুপমের কালজয়ী কাজ।
তফাৎ কী জানেন! এই কথাগুলো শুধু ফেসবুকে নয়, জানিনা অনুপম বলতে পারবে সঠিক, ওর সবচেয়ে বেশি বইয়ের আলোচনা করেছি আমি, দীর্ঘ সব আলোচনা।
হ্যাঁ, সে আলোচনায় সখ্য কোনো ছায়া ফেলেনি।
আমি একজন পাঠক যে শিকারীর মতো লোভ লালসা নিয়েই শিকার ধরতে চেয়েছি।
অনুপমের দীক্ষা ও পথ আলাদা কিন্তু ও তো দেখতে শিখিয়েছে আমাদের, অস্বীকার করি কী করে?
আজ থেকে ১২ বছর আগে অনুপম লিখেছেন,
"ছায়ার গলিতে মিশে যাচ্ছে রোদ, কাচ ভাঙার /শব্দ(মেদনিপুরের গলি)
কিংবা 'শার্ট' কবিতায় লিখছেন,
"এই কবিতার পাঠক কি জানেন---তাঁর শার্টের হাতার মধ্যে/তালু এবং আঙুলগুলির জন্য কোনো বিবেচনা সেলাই করা /হয়নি?"
এই কবিতা লেখার ক্ষমতাকে কুর্নিশ করতে হবেনা?
এই অনুপমই তো লিখেছেন:
"সিংহের বনে রোদ পড়েছে।"
আপনাদের ক'জনের এই সুযোগ ঘটেছে জানিনা এই নিরালাপ্রিয় আত্মমর্ষ কবি অনুপমের সঙ্গে শিলাবতীর তীরে হেঁটেছি। ও তখনই তো স্পর্শের বাইরে। হোঁচট খেয়েছি হাঁটতে হাঁটতে, ঝুঁকে পড়া বাঁশগাছের মাঝে ঢুকে পড়েছে গোদার, ভ্যানগখ, পাশে শান্ত শিলাবতী কিন্তু যারা জানে তারা জানে যে, সে কত ভীষণ ক্ষুরধার, অনুপমও অনেকটা তেমন। সেইসব অনেক কথা।
যাইহোক, অনেক দেরিতে
এই ২০১৮-১৯ এর কবিতা পেয়েছি, প্রথম পাঠেই মনে হল, একটা যেন বৃত্ত শেষ করলেন কবি।
এত বিচিত্র, বহুমুখী কবিতা আর ধারণার নজির সাম্প্রতিক বাংলা সাহিত্যে নেই।
এই বইতে প্রায় অপ্রত্যাশিত ভাবে ছন্দ নিয়ে কাজ করেছেন অনুপম। কী অসামান্য কাজ! হ্যাঁ, এই লেখালেখিকে অনুপম কাজ বলেন, আমি বলিনা।
আপনারা বুদ্ধি ও মন দিয়ে তা লক্ষ করুন,
"লিখিত স্মৃতির নাম অভিজ্ঞতা যদি/
সব লেখা পৃথিবীতে আগে হয়ে আছে
সব দিতে চায় লেখা শব দিয়ে যায়
মড়া পোড়ানোর ঘ্রাণ যেমন রচনা"
কবিতার কোনো ব্যাখ্যা হয় কি!
করছিওনা।
শুধু পড়তে ও ভাবতে বলছি, "ঘোড়ার লাঞ্ছনা দেখে ঘোড়ার বৌ ফুঁসছে/
কেন তার চোখ থেকে আত্মহননের জল/
কেড়ে নেওয়া হল"
কিংবা 'আমার দেশ' কবিতাটি, নাঃ আর উদাহরণ দেব না, বইটি কিনে আনুন এবার।
শুধু অনুরোধ, হে শিকারি পাঠক, অনুপম শিকারে নামুন।
__________________________________________________________________________________________



 কবি বিদিশা সরকার ফেসবুকে লিখছেন--


"অনুপম মুখোপাধ্যায়ের কবিতার সঙ্গে পরিচয় বেশ কিছু বছর ধরে। 'কবিতা ক্যাম্পাস'-এর অনুষ্ঠানে ওঁর সংক্ষিপ্ত ও সম্পূর্ণ বক্তব্য পেশ করার মধ্যে একটা অ্যাটিটিউড আমাকে অবাক করেছিল। কবি এলেন, বললেন, চলে গেলেন। মনে হচ্ছিল অদৃশ্য কয়েকজন কম্যান্ডা ওঁকে দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিল। তার পরেরটুকু " রক্ত ছিটিয়ে রক্তহীন এ দেশে/ থ্রিলার বানাই"। এই লাইনটা অনুপমের নতুন বই" কবিতা ২০১৮-১৯ " অমৃতজাতক কবিতা থেকে নেওয়া। কোনো পরিকল্পিত উপায়ই কবিতার জন্মক্ষন নয়। কবি দায়বদ্ধ শব্দের কাছে, শব্দসঙ্গে -- সাধুসঙ্গ বা কবিসঙ্গের থেকেও যা উৎকৃষ্ট। গোটা এক বছরের কবিতা ধারণাকে তাঁর শৈলীতে সময়ানুগ ভাঙচুরের মধ্যে দিয়েই নির্মাণের নতুন আঙ্গিক পুনরাধুনিক কবিতা।

"হাইপার পাঠকের ভয়ে
প্রত্যেক কবিতায় লাইন হারাই
শব্দ লিখতে গিয়ে ভীতু হয়ে
যাই
পশু যথা ক্লান্ত হয়
কোবিদের ভিড় থেকে
লুকিয়ে পালাই "

এই স্তবকের মধ্যে এমন কিছু ব্যাপার আছে যা গভীর ভাবে ভাবতে গেলে আপাত কবিরাও একটু থমকে যাবেন। কারণ থমকে যাওয়া উচিত। উনি কিন্তু এই কবিতায় কবি শব্দটার পরিবর্তে বলেছেন 'কোবি' । বলা বাহুল্য আত্মচর্চার প্রতি আঙুল তুলে দিলেন। গ্রহণ / বর্জন পাঠকের দায়। এই যে পরিমিতি বোধ তার নিরিখেই
"ক্যানাইন দাঁত থেকে
লুকিয়ে পালাই
আমারও তো দাঁত আছে
মাংস ছিঁড়ে খাই" --

বাকিটুকু লিখলাম না। অমৃতজাতক আসলে অ-মৃত জাতক। তার প্রাণ আছে,সাড়া আছে, পুনঃ পুনঃ জন্মমৃত্যুর অভিজ্ঞতাও। এই একটা কবিতার মধ্যেই আমরা আংশিক অনুপমকে পেয়ে যাচ্ছি। এত কবিতার মধ্যে তিন চারটে কবিতা বেছে নিয়েছি। বাকি কবিতা বইটা হাতে নিলেই পড়ে নিতে পারবেন।

২) " চোখের তেষ্টা জিভে বয়ে কতটা বাঁচব
জিভ থেকে জল তুলে
নিলে কেন যে বাঁচব " --
কবিতার নাম‌ " গঙ্গা"। সহনশীলতার পরাকাষ্ঠা।‌ এর থেকে বেশি বলা ঠিক নয়। আমরা যে যার মতো কবিকে খুঁজে নেব।

৩) চমৎকার রাত এই অ্যাতো ভালো ঘর
আমার খাওয়ায় দুটো রুটি বেলে রেখো
রুটিগাছ ঢেকে দ্যায় জানলার আলো
সে বাড়িতে থাকি আমি ভাত খাই রাতে .....",
কবিতার নাম" রুটিগাছ"।

বইয়ের মাঝখানের কবিতা থেকে শুরুর কবিতায় ফিরে এলাম বা বলা যাক ঠিকানায় ফিরে এলাম। আমাদের যাপন, আমাদের অভ্যাস, আমাদের কুলুপ আঁটা দুপুর প্রধান জীবনে। কবিতাটা পড়তে পড়তে আমার চোখে জল এসে যায়। হ্যাঁ আমার।

৪) "বরফে মজেছি আমি হরফে মজেছি
নিজেকে মারার সুখ কোন শালা চায়
পাথরকে কাটি কেন মূর্তির পোশাক
যে কোনো দূরত্ব থেকে সেক্স করে নিই" ( পাগল ছাড়ো পা)।
কবিতার শেষ চারটে‌ লাইন থেকে দুটো শব্দকে আলাদা করে ভাবলে হয়ত ভুল হবে না। বরফ আর হরফ। বরফে হরফ লেখা প্রেমিকের ঘোষণায়। যে এ যন্ত্রণায় মজেছেন সে-ই তো নিজের ঘাতক। আর মাথা খারাপ করে দেওয়া শেষ লাইন-

...." মাঠে একা দাঁড়িয়ে থাকছে মই
পুজোশেষে এখান থেকে
গরম কুসুম
আলো নামানো হবে ......
.... আকাশে বেরিয়ে পড়ার গুচ্ছ
ভ্রমণকাহিনি যত মৌগন্ধী হচ্ছে
দৈত্য থেকে বেরিয়ে আসা
চেরাগ চাইছি আমি"

----- এ বিষয়ে আমার আর কিছু বলার নেই। পাঠমধ্যে নিমজ্জিত।

_______________________________________________________________________



 কবি অনির্বাণ দাশ লিখছেন-

#অনুপমের_কবিতা_১৮_১৯

বাংলা কবিতার পুনরাধুনিকতাবাদের একমেবাদ্বিতীয়ম কাণ্ডারী অনুপম মুখোপাধ্যায়-এর কবিতা-পুস্তিকা 'কবিতা ২০১৮-'১৯' হাতে এলো বন্ধু সৌমেন চট্টোপাধ্যায় -এর মারফত। দু-চারবার পড়লাম।

সৌমিত্র হড়ের আঁকা প্রচ্ছদ বেশ। কিন্তু মলাটের কাগজ এই মানকে ধারণ করতে অক্ষম। 

জানি না উৎসর্গ সেভেন সামুরাই-কে করার প্রাসঙ্গিকতা কী।হয়তো শুধু নিবেদন নয়, কবিতায় যে স্বপ্ন কবির তা বোধ করি সুদূর প্রাচ্যের বীর যোদ্ধার জন্যেই আবর্তিত। 

যতিচিহ্নহীন কবিতার যে-চল হয়েছে সেই রীতি, শব্দ কেটে শব্দ (হরিণ/whoring, বোদলেয়ার/গালিব) অনুপমীয় রীতির প্রয়োগ, একটা>১টা,পড়ছে >


ছে
এইসবের পরিমিত ব্যবহার মোহিত করে।
"কতল হয়েছে কেউ কোতুলপুরের"-- ক-এর দারুণ অনুপ্রাস।আমার বর্তমান বাসভূমি 😃।প্রাচীন একটি হাপুগানে এই স্থাননামের উল্লেখ পেয়েছিলাম।

'মায়ের গোসল' একটি অনবদ্য কবিতা। এখনও পর্যন্ত এই শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা। 'মৃচ্ছকটিকম্' বেশ ভালো।

অক্ষরবৃত্তের(৮+৬) কী দারুণ পুনরাধুনিক প্রয়োগ। পরাবাস্তববাদ ঝিলিক দিয়ে ওঠে। আরও কত কী অলংকার এই নিরলংকৃত পদ্যবন্ধে।
"সাধারণ লোকের চোখে
অনধিকার সূর্যোদয় হয়"

কবিকৃতির সুপরিমিতি বইটিতে। শেষের আলোকচিত্রটি সুন্দর। বিবরণটিও।


___________________________________________________________________________


 শুভদীপ নায়ক লিখছেন-

 বইটির ২০০ কপি শেষ, এটা খুবই আনন্দের বিষয় । হয়তো আগামী ১০০ কপিও পাঠকের কাছে পৌঁছে যাবে দ্রুত । ৩০০ কপির পর, আবার একটা অপেক্ষা তোমার নতুন কাজের । কিন্তু এবার একটা অন্য বিষয় বলি, প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার যে প্রসঙ্গটি এখানে তুললে, সেই প্রসঙ্গে । এই মুহূর্তে বাংলা সাহিত্যে গবেষণা ও গতানুগতিক ধারার বাইরে দাঁড়িয়ে তোমার নিজস্ব দর্শন বা কাজকে নিজের জায়গা করে নিতে হচ্ছে বিশ্বসাহিত্যের প্রেক্ষাপটে । উত্তরআধুনিকতা, রিয়ালিজম্, স্যুরিয়ালিজম্ এসব পেরিয়ে বিশ্বসাহিত্য কবেই গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের হাত ধরে হাইপাররিয়ালিজমে প্রবেশ করেছে । তোমার এর আগের বইগুলো পড়ে, বিশেষ করে 'অনুপমের কর্মফল' নামক পাৎলা বইটি পড়ে বুঝতে পেরেছি তুমি এসব ধারারও বাইরে নিজেকে নিয়ে এসেছ । পোস্টমডার্ন সাহিত্য অতিক্রম করে Re-modern সাহিত্যে এসে পৌঁছে গেছ । আশ্চর্যের বিষয় হল, তোমার সত্যিকারের পাঠক কিন্তু নেই, তোমার বই পড়ে ডিসকোর্সে যেতে পারে, এমন পাঠক নেই, থাকলেও তারা সংখ্যায় কম, সেই পাঠক আসবে পরে, দেরিতে । তাহলে প্রশ্ন হল ২০০ কপি কিনল কারা । ২০০ কপির মধ্যে ১৭৫ কপির পাঠকেরা লুকিয়ে আছে বহু প্রতিষ্ঠানের নিচে যারা গোপনে তোমার দর্শন জানতে চায়, কিন্তু তারা প্রকাশ্যে দ্বারস্থ হয়ে আছে মঞ্চে, অনুজ্ঞাবহ হয়ে আছে গতানুগতিক লেখালিখির মধ্যে । তারা প্রত্যেকেই কম বেশি লেখার সঙ্গে যুক্ত । তুমি বহু জায়গায় আলোচিত । অঙ্ক কখনো মিথ্যে বলে না । বিক্রির এই অঙ্ক একথাই প্রমাণ করে । এই ১৭৫ জন ক্রেতা হল পুনরাধুনিক লেখা সম্পর্কে আগ্রহী মানুষ, পুনরাধুনিক দর্শন সম্পর্কে জানতে আগ্রহী ব্যক্তিবৃন্দ হল এরা । এরা গোপনে তোমাকে ভবিষ্যতের প্রতিষ্ঠান বানিয়ে তুলবে । সে বিষয়ে তুমি জানোই হয়ত । এটাকে কীভাবে নেবে তুমি তোমার আগামী কাজগুলোর মধ্যে দিয়ে ? আমার মতে সময় এসেছে কবিতা, উপন্যাসের পাশাপাশি তুমি তোমার পুনরাধুনিক চিন্তাচেতনার লেখাপত্রগুলো দার্শনিক পাণ্ডুলিপি আকারে লেখা শুরু করো । যে কাজ বার্ট্রাণ্ড রাসেল শুরু করেছিল কিন্তু পৌঁছাতে পারেনি তাঁর রোম্যান্টিক বা স্যাডিস্ট ভূমিকার দরুণ । তেমনটা হলে কাজগুলোতে অনুসন্ধানের আরো অনেক পরিধি তৈরি হবে।



অনুপম মুখোপাধ্যায়ের কবিতা ২০১৮-১৯আরেকবার ছাপা হয়ে রেডি হয়েছে। পাওয়া যাচ্ছে কলকাতার ধ্যানবিন্দু’, ‘সুপ্রকাশ বইঘর’-এ। কৃষ্ণনগরের সংকলন’-এ। মালদার পুনশ্চ’-এ। মেদিনীপুরের ভূর্জপত্র’-এ। বর্ধমানের 'নবনী বুক স্টল'-এঅনলাইনে সরবরাহ করছেনঋতভাষসাহিত্যসংস্থা- https://www.writobhasprokashoni.com/p…/anupam-mukhopadhyay/… এই লিংকে ক্লিক করলে বইটি বাড়িতে পৌঁছে যাবে। যদি চার কপি অর্ডার করেন, কমিশন পাবেন, ডেলিভারি চার্জ লাগবে না, দোকানের দামেই বইটির কপিগুলি পেয়ে যাবেন এবং বন্ধুদের দিতে পারবেন।।



No comments:

Post a Comment