মহামারী ও সোশ্যাল মিডিয়া ('একদিন' সংবাদপত্রে প্রকাশিত)





বাঙালি বহুকাল মহামারীর সম্মুখীন হয়নি। যে বাঙালি একসময় কলেরার তুঙ্গ সময়েও পচা পুকুরের জল সম্বল করে ঝাড়েবংশে নির্মূল হতে হতেও কোন এক জাদুবলে বেঁচে থাকত, যে বাঙালি ম্যালেরিয়ার মশার কামড় সহ্য করতে করতে খালের ধারে শোলমাছ ধরতে বসত কুইনাইন আবিষ্কার হওয়ার আগে, যে বাঙালি প্লেগ নামক আন্তর্জাতিক মড়ককে অতিক্রম করেছে এবং রবীন্দ্রনাথ ও শরৎ চন্দ্রের উপন্যাসে তাকে অক্ষয় করে রেখেছে, সেই বাঙালি আজকের নয়। সেই বাঙালি বেশ কয়েক প্রজন্ম আগেকার। সেই সময়ের বাঙালির ধাত আর ধাতু আজ আমরা হারিয়ে ফেলেছি নিজেদের মধ্যে। আজ আমরা অল্পেই ত্রস্ত হয়ে পড়ি। যে দুর্বিপাক তার পূর্ণ শক্তি নিয়ে আছড়েই পড়েনি, আমরা তার পথ চেয়ে থাকতে থাকতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ি, স্নায়বিক হয়ে পড়ি। একটা বিপর্যয় আসার আগেই তার ভয়াল রূপ এখন সবার আগে আছড়ে পড়ে সোশ্যাল মিডিয়ায়। যতটা ক্ষতি সে করতে পারবে, তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি কল্পনা করা শুরু হয় একের পর এক পোস্টে।
          আগে যখন কোনো উপদ্রবের সম্ভাবনা দেখা যেত, যেমন হয়ত জাপানি বোমার আক্রমণ বা কলেরার সংক্রমণ, তা নিয়ে বাঙালি কোথায় বসে আলোচনা করত? সে আলোচনা করত সাবেকি বৈঠকখানায়, বা লন্ঠনজ্বলা চণ্ডীমণ্ডপে। সেখানে লোক হত মুষ্টিমেয়। ফলে বাইরের অন্ধকার থেকে ভিতরে আসা ভয়ের ছায়া ভিতর থেকে বাইরে অত আগ্রাসী হত না। চায়ের দোকানে যতই তুফান উঠুক, সে তুফান জনাকয়েককে ছাড়িয়ে বাইরে যেত না। গুজব জিনিসটা আজকের মতো সর্বগ্রাসী আর সর্বত্রগামী হওয়ার পথ পেত না তখন। সোশ্যাল মিডিয়া যে সে পথ কত চওড়া করে খুলে দিয়েছে, সেটা গত বছর ফণী ঘূর্ণিঝড়ই বুঝিয়ে দিয়েছিল। আর এই মুহূর্তে মারাত্মকভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছে করোনা ভাইরাস। এখন ফেসবুকে নেই এমন বাঙালির সংখ্যা খুব কম। ‘যা নেই মহাভারতে, তা নেই ভারতে’ একসময় বলা হত। আজ বলতে হয় ‘যা ফেসবুকে নেই, তা কোথাও যেন নেই’। এমতাবস্থায়, যখন একজনের একটা উদাসীন পোস্ট কয়েক হাজার লোকের কাছে পলকে পৌঁছে যেতে পারে, সোশ্যাল নেটওয়ার্ক ব্যবহারের দায়িত্বটাও যায় অনেকখানি বেড়ে। সেই স্পাইডারম্যান সিনেমার সংলাপের মতোই- অনেক বেশি শক্তির সঙ্গে সঙ্গে আসে অনেকখানি দায়িত্ববোধের প্রশ্ন। আমরা নেটিজেনরা অনেকেই প্রায়ই হিড়িকের বশে সেই দায়িত্ব ঠিকঠাক পালন করছি বলে মনে হয় না, প্রায়ই আমরা আন্তর্জাল ও সোশ্যাল মিডিয়ার প্রয়োগ ভুলভাবে করি  
          করোনার আগমণবার্তা সদ্য যখন থেকে শোনা গিয়েছিল, ভারত এবং বাংলাদেশ মিলিয়ে বাঙালিদের মধ্যে দু-রকম মনোভাব দেখা গেল। একদল সরাসরি ভয় পেয়ে গেলেন, এবং অন্যদের মধ্যে সেই ভয় সঞ্চারিত করার কাজ শুরু করলেন, অর্থাৎ ভয় ছড়াতে শুরু করলেন। তাঁরা এটা খেয়াল রাখলেন না যে কোনোকিছু যদি ভীতিপ্রদও হয়, সামাজিক ক্ষেত্রে তার প্রতিষেধক একমাত্র সাহস আর অভয় দিয়ে করতে হয়। আরেকদল বেশ ডাকাবুকো, তাঁরা সাধারণত তরুণ, যথারীতি দেখা গেল তাঁদের মধ্যে ভয়টয় নেই, কিন্তু আছে মজা করার লাগামছাড়া প্রবণতা। তাঁরা যথারীতি মিমস্‌ এবং ট্রোলিং শুরু করলেন অসুখটিকে লক্ষ্য করে। এতে যেটা হল, এই অসুখের যে সত্যিকারের সতর্কতামূলক দাবি, সেটা যেন মেটানোর দরকার নেই, অসুখটা যেন হাসতে হাসতে আসবে এবং হাসিমুখে চা-বিস্কুট খেয়ে নিজের বাড়ি চলে যাবে এমন এক ফুরফুরে আবহাওয়া বিস্তার পেল। একদিকে দিল্লী চলো ধরণের গাম্ভীর্য, আর অন্যদিকে বেপরোয়া খিল্লি, এই দুই পরস্পরবিরোধী মনোভাব বুঝিয়ে দিচ্ছিল একটা জাতীয় বিপর্যয়কে সোশ্যাল মিডিয়ার সচেতনতায় মোকাবিলা করার মতো পরিণত মনোভাব আমাদের বেশির ভাগের মধ্যে এখনও সেভাবে গড়েই ওঠেনি।
          এরমধ্যে যখন কলকাতার প্রথম করোনা রোগী ধরা পড়লেন, এবং দেখা গেল তিনি বয়সে খুব তরুণ, বিদেশ থেকে সংক্রমিত হয়ে ফিরে তিনি নিজের অসুস্থতার বিষয়ে যথেষ্ট দায়িত্ববোধের পরিচয় দেননি, তাঁর প্রভাবশালী পরিবারের মধ্যেও সেই দায়িত্ব পালনের অভাব ছিল, সোশ্যাল মিডিয়া তাঁকে সরাসরি দোষারোপ শুরু করল। অবশ্যই দোষ তাঁর এবং তাঁর পরিবারের রীতিমতো আছে। সেই দোষ দেখিয়ে দেওয়ার দায়িত্বও সোশ্যাল মিডিয়ায় মানুষদের সচেতনভাবে পালন করতে হবে, কারণ ওই তরুণের মতো আরো অনেকেই নিজেদের সংক্রমণ লুকিয়ে বিপুল সংখ্যক মানুষকে বিপন্ন করতে পারে। কিন্তু দেখা গেল তরুণটির চেহারা আর মুখশ্রী নিয়ে প্রচুর কথাবার্তা ও বিদ্রুপ চলছে। অসুস্থ তরুণটির গায়ের রং যে কালো, এবং তিনি সেই কালো চেহারা নিয়েও বিদেশে গিয়ে একজন অন্য দেশের তরুণীর মাধ্যমে সংক্রমিত হয়েছেন, সেটার দিকে ছবি পোস্ট করে ইঙ্গিত শুরু হলএটা সত্যিই মানা যায় না। এ থেকে বোঝা যায় আজও আমরা মানুষের চরিত্র বিচারের ক্ষেত্রে তার গায়ের রং আর মুখের অবয়বকে কতখানি গুরুত্ব দিয়ে থাকি। একজন মানুষের অপরাধের বিচার তার আচরণ আর কৃতকর্ম থেকেই হওয়া উচিত, এটাও যে এই ২০২০ খ্রিস্টাব্দে এসে আমরা শিক্ষিত বাঙালিরা মনে রাখছি না, এমনকি তা নিয়ে প্রকাশ্যে ব্যক্তিকে আক্রমণও করতে পারি, সোশ্যাল মিডিয়া তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। ফর্সা চামড়ার প্রতি বাঙালির যে অদম্য টান, তা কি ব্রিটিশ আমল থেকে আজ অবধি প্রবাহিত হচ্ছে? আর কতদিন হবে? এ কিন্তু সেই নেটিভ মানসিকতা।
          করোনার মুখে দাঁড়িয়ে যখন চরম কুসংস্কারী কিছু মানুষ গোমূত্র পানে রোগমুক্তির নিদান দিচ্ছেন, তার মোকাবিলাতেও দেখা গেল সোশ্যাল মিডিয়া এককাট্টা নয়। কিন্তু মানুষ পেলেন নির্মল মজার খোরাক, এবং একের পর এক লঘু পোস্ট আসতে শুরু করল। পরিবেশ তার ফলে হাল্কা হল। সেটা ক্ষতিকর নয়। আরেকদল পেলেন রাজনীতির সুযোগ। বোঝা গেল, রাজনীতি আজ আমাদের এতটাই গভীরে প্রবেশ করে বসেছে যে তাকে বাদ দিয়ে আমরা মহামারীর সঙ্গেও সংলাপে আসতে পারছি না। আমরা হয়ত বার্গম্যানের সেই অমর সিনেমা ‘দ্য সেভেন্থ সিল’-এর জনসমষ্টিতে পরিণত হচ্ছি, যারা প্লেগের মুখে বিভ্রান্ত, যারা তারপরেও তাদের ক্ষুদ্র লোভ, ক্ষুদ্র স্বার্থগুলো নিয়ে মৃত্যুর সামনে দাঁড়াবে, কিন্তু মৃত্যু তাদের শিকার করে খুশি নয়, সে সন্ধানে থাকবে কিছু অকুতোভয় যোদ্ধার যাদের সঙ্গে তাদের দাবাখেলাটা জমবে ভাল, যদিও লুকিয়ে লুকিয়ে সে তাদের মুখ থেকেই তাদের চালের হদিশ জেনে নেবে।
          আরেক ঝামেলা হল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি নিয়ে। দেখা গেল এপারে সমালোচনা চলছে কারণ সরকার ছুটি দিয়েছেন, আর বাংলাদেশে সমালোচনা চলছে কারণ সরকার তখনও ছুটি দেননি। শেষ অবধি দুপারেই বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়গুলোতে ছুটি হল। অবিশ্যি সেই ছুটি সবার কাছে স্বাগত নয়। কিছু শিক্ষক প্রকাশ্যে পোস্ট দিলেন তাঁরা সরকারের এই সিদ্ধান্তের ফলে শ্রেণিশত্রু থেকে গণশত্রুতে পরিণত হচ্ছেন, এবং এটা ষড়যন্ত্র। আবার বোঝা গেল সবাই মিলে সবকিছু ভুলে একটা জাতীয় বিপর্যয়ের সামনে দাঁড়ানোর একতা আমাদের মধ্যে নেই। যখন করোনার মতো একটা ব্যাধি ধেয়ে আসছে, তখন সর্বাগ্রে বিচ্ছিন্নতা প্রয়োজন, এবং তা হওয়া উচিত নিঃশর্ত। এই মুহূর্তে যখন করোনা আমাদের দরজা পেরিয়ে ঢুকে পড়েছে, তখন কোনোরকম শ্রেণিচেতনার অবকাশ হয়ত নেই। এই ব্যাধির কবল থেকে রেহাই পাওয়ার একমাত্র উপায় হল একা হয়ে যাওয়া, এবং অন্যকে একা হতে সাহায্য করা
          করোনা যে একাকীত্ব দাবী করছে, তা কিন্তু বেশ প্রতীকি। এই যে সময়, যখন সোশ্যাল মিডিয়ায় আমাদের হাজার হাজার বন্ধু, সেখানে দাঁড়িয়ে হঠাৎ মনে হতে পারে, আমরা কি আজ ইতিহাসের মধ্যে সবচেয়ে নিঃসঙ্গ একটা প্রজাতি নই? এর চেয়ে অধিক একা মানুষ আর কবে ছিল? এই যে একটা ছবি পোস্ট করে একশ দুশ বা সাতশ লাইক আর কমেন্ট আমরা পাই, সেগুলোর একটাকেও কি আমরা স্পর্শ করতে পারি? সেগুলো মিথ্যা নয়। সেগুলো সত্য, অবশ্যই। এমনও হতে পারে সেগুলো সত্যের চেয়ে বেশি, যাকে বলে অতিসত্য, আর তাই সেগুলো আমাদের ব্যক্তিগত নয়। সোশ্যাল মিডিয়ার যে হাজার হাজার অলীক বন্ধুবান্ধব, যাদের আমরা খুব অল্পই চিনি, তবু তাদের লক্ষ্য করেই আমরা অনেক সময় এমন কথা বলে ফেলি যা আসলে আমাদের নয়, তারা শুনতে চায় বলেই যেন সেসব কথা বলা, যাতে তারা সোল্লাসে সাড়া দেয়, একটা পোস্ট যাতে জমজমাট হয়। আমরা অনেকে তাদের লক্ষ্য করেই এমন কথা বলি যা আসলে বলতে চাই না, বিশ্বাস করি না, কিন্তু না বললে তারা আমাদের আর গ্রহণ করবে না। এ কি একাকীত্বের সবচেয়ে নিষ্ঠুর রূপ নয়? সোশ্যাল নেটওয়ার্কে যে আমরা আজ সবাই সেলিব্রিটিদের মতো একা, কিন্তু কতখানি সুযোগসুবিধাহীনভাবে, করোনা নামক মহামারী তার প্রথম স্পর্শে আমাদের বুঝিয়ে দিচ্ছে। তার হাত থেকে বাঁচতে হলে আমাদের একা হতে হবে, অথচ একাকীত্বই তো আমাদের এখন করুণ নিয়তি।
আমাদের স্মার্টফোন ল্যাপটপ আর ডেস্কটপ আমাদের ইতিহাসের সামনে একা করে দিয়েছে। বাকি ছিল গৃহবন্দী করা। সেটা করোনা করল। এটুকুই চাইতে পারি, এই ব্যাধি যখন আমাদের রেহাই দিয়ে চলে যাবে, যেন আমাদের জাতীয় চরিত্রে কিছু শুভ বিবর্তন ঘটে, এবং তার ছাপ যেন সোশ্যাল মিডিয়ায় পড়েততদিন সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমেই আমরা আমাদের বন্ধুদের সতর্ক ও সচেতন রাখি। পাশে থেকে তাদের একাকীত্বের বোধে কিছুটা ভাঙন ধরাই। যদি বন্ধুতালিকার মধ্যে কেউ সংক্রমিত হন, তাঁর সেই ত্রাসের মুহূর্তে যেন আমরা সঙ্গী থাকতে পারি। হাতে হাত না রাখতে পারি, অনেক দূর থেকে, হাজার হাজার কিমি দূর থেকেও আজ নিজেদের উপস্থিতি তাঁর অসুস্থ শরীরের পাশে আমরা জানিয়ে দিতে পারি। এ যে আন্তর্জালের কতখানি আশির্বাদ! এই সুযোগ তো রবীন্দ্রনাথ দিতে পারেননি তাঁর ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসের জ্যাঠামশাইকে। প্লেগ রোগীর না হোক, করোনা রোগীর সেবা করার সুবাদে নিজেদের প্রোফাইল পিকচারে একবার বাংলা সাহিত্যের অমর চরিত্রদের ঝলক দেখার সুযোগ আজ যে আমরা পেলাম, তা যতই ভার্চ্যুয়াল হোক, সে বড় কম কথা নয়।  
         


No comments:

Post a Comment