![]() |
last moments of karna by Prashant Yampure |
[মহাভারত ১ নয়। মহাভারত অনেক। সকলের আছে এক আমার নিজস্ব
মহাভারত। এই লেখাকে গবেষণামূলক বলা যেতে পারে। আবার সংগ্রহমূলকও বটে। মহাভারতের
ক্রিয়াভিত্তিক পাঠের লোভ আমার আজও জাগেনি। লিখিত কাহিনিটির (?) ঔপনিবেশিক
পাঠাভ্যাস বজায় রেখেই, সেই প্রথম কৈশোর থেকেই, কর্ণ আমার প্রিয়তম চরিত্র। তার
সম্পর্কে যেখানে যা পেয়েছি খুঁটিয়ে পড়েছি প্রায় গোগ্রাসে। ফলে
অনেকগুলো দৃষ্টিকোণ থেকে এই চরিত্রকে আমার দেখা হয়ে গেছে। পরে অনেক কবিবন্ধুকে
শুধিয়েছি তাঁদের মত কর্ণ সম্পর্কে। একটা জিনিস দেখেছি, এই লোকটি সম্পর্কে উদাসীন
থেকে কেউ মহাভারত নামক গ্রন্থটি পড়েননি। কর্ণের প্রতি মতামত থেকে একজন মানুষের
নিজের নৈতিকতার বিচার হয়তো হতে পারে। লোক হিসেবে সে যে আদৌ ভাল ছিল না, তা বলা
যায়। মহাভারতে কোনো চরিত্রই ভাল নয়, সকলের মধ্যেই দোষ আছে। দোষহীন মানুষ মহৎ হয়
না, বিরাট হয় না, খামি ছাড়া ময়দা থেকে রুটি হয় না, যেমন হাতহীন মানুষ তিরন্দাজ হয়
না। আমি মনে করি এই লোকটি নিজেকে আহুতি দিয়েছিল, এবং সে ভারতবর্ষের প্রথম অ্যাংরি
ইয়াং ম্যান, ‘দিওয়ার’-এর বিজয় বর্মা আসলে এই আর্কিটাইপটিকেই মান্যতা দেয়। অনেকের
কাছে নিজের ভূমিকা অক্ষুন্ন রাখার দায় বর্তমান ভাগলপুরের এই প্রাক্তন রাজাটির ছিল।
এই কবিতায় সেটাই স্পষ্ট করতে চেয়েছি, পাঠকের চোখে নয়, সে সাহস নেই, এ আসলে আমার আত্মসমীক্ষা।
ব্যাসদেবের প্রতি (অথবা যাঁদের ব্যাস বলা হত) অনুগত থাকতে পারলাম না, আশা করি
হাজার হাজার বছরের ক্ষমা আমাকে বঞ্চিত করবে না।]
আচখ্যুঃ কবয়ঃ কেচিৎ
সম্প্রত্যাচক্ষতে পরে।
আখ্যাস্যন্তি তথৈবান্যে ইতিহাসমিমং
ভুবি।।
।
কর্ণ : অধিরথসূত আর রাধামা-র ছেলে
আমি কর্ণ, দেবব্রত। প্রণাম নেবেন।
ভীষ্ম : আরে, এসো অঙ্গরাজ! আছি প্রতীক্ষায়।
তোমার দেখা যে পাবো, জানা ছিল
আজ।
পৃথক কিছুই নয়, এই রণভূমি,
প্রচন্ড
গ্রীষ্মের বুকে যেন রাজপথ,
জনারণ্য, তবু দ্যাখো একা শুয়ে আছি।
সাক্ষাতের ইচ্ছা
শুধু তেষ্টাই বাড়ায়।
কর্ণ : মহারথী ভীষ্ম যাঁর স্বেচ্ছামৃত্যু বর,
তাঁর যে পতন হবে, অভাবিত ছিল!
আজ তিনি
ভূপতিত, শিখন্ডীর ছলে,
অবশ্য মরণ নয়,
মহা বীরগতি!
ভীষ্ম : লোকে দেখে বীরগতি, যে মরে সে
জানে
মৃত্যু শুধু মৃত্যু হয়, ইচ্ছা
শুধু ভান।
এ তো নয় আত্মহত্যা, অত লঘু নয়,
তার চেয়ে জেনো ঢের যন্ত্রণাদায়ক।
নেই কোনো অজুহাত, গোপন আশ্রয়।
মৃত্যুতেও এ ক্লেশের হবে না
তো শেষ।
স্বর্গবাস পাবো জানি, কিন্তু
তার আগে
অবশ্যই পেতে হবে নরকের দেখা-
এ জীবনে পাপ খুব কম করিনি তো।
অর্জু্নের এক বাণে উঠেছিলেন
মা,
জিভ শুকনো কাঠ ছিল, পেয়েছে সে
জল।
কিন্তু এই বুড়োটার অসরল মন,
বুকের যে দূরে শুধু বিজনের
বাস,
সে তো কারও গম্য নয়। সে
শুধু আমার।
কর্ণ : দেখুন আমিও তো বিজনেরই লোক!
সারথীর ছেলে আমি, আভিজাত্য নেই,
জন্ম শুধু
দিয়ে গেছে ভিড়ের আড়াল।
কোনোভাবে
নিজের না অপমান হয়-
প্রতিষ্ঠার
স্বপ্ন নিয়ে সে এক লড়াই।
দৈবের আয়ত্বে
ছিল কূলের গৌরব-
আমার সম্বল
শুধু নিজের পৌরুষ।
বরং যে
অতিবৃদ্ধ এই মহারণে
দশ দিন কৌরবের
রক্ষা করেছেন,
যাঁর মতো কোনো
কুরু নন ধর্মশীল,
কোষবৃদ্ধি
মন্ত্রণা বা ব্যূহের রচনা
যাঁর
পদপ্রান্তে বসে শিখে নেওয়া যায়,
তাঁর দেহ
শরশয্যা নিজে বেছে নিয়ে
দশাসই ঘোর কালো সজারু সেজেছে।
আপনার মুখে এত হতাশার ছায়া
এত কষ্ট এত গ্লানি এত পাপবোধ
ভাবিনি তো কোনোদিন দেখা দিতে
পারে।
ভীষ্ম : আমার কি ক্লান্তি নেই! অবসাদ
নেই!
শরশয্যা বুঝি
খুব আরামদায়ক!
ক্ষমা করো যদি
পাও বিদ্রূপের সুর।
এত বাণে বিদ্ধ
আমি বেঁচে আছি বটে,
আমাকে কি
যন্ত্র ভাবো? শুধু বাহুবল?
কর্ণ : বাহুবল নিয়ে সেই আদিম বিশ্বাস
আমার ভিতরে যেন টলে গেছে খুব।
দেবব্রত, আজ বড় বিচলিত আমি।
উদ্বেগ দুশ্চিন্তা আর সঙ্গহীন
বোঝা
সে তো চিরকাল একা বয়েই চলেছি।
তবু তো অভ্যাস তার কিছুতে হল
না।
কী জানেন একাকীত্ব অভ্যাস হয়
না।
চিন্তা আর চেতনার চড়াই-উৎরাই,
ধনুকের ভার নিয়ে... আর যে
পারি না।
আমিও তো বৃদ্ধ আজ, আর কত যাব!
কর্ণের শৌর্যকে লোকে সামগ্রী
করেছে,
বিনিময় হয়ে গেছে, সতীত্ব যেমন-
ভীষ্ম : অঙ্গরাজ হয়েছ তো, দুর্যোধন সখা!
কর্ণ : সুযোধন বন্ধু ঠিকই, সখা তিনি নন।
বন্ধুত্ব
বিকিয়ে যায় প্রতাপের হাটে।
কর্নের সুরক্ষা পেতে সকলেই
চায়,
কিন্তু তার প্রাণসখা আজও কেউ
নেই।
অর্জুনের প্রতি তাই ঈর্ষা হয়
খুব-
সামর্থ্যের জন্য নয়, কৃষ্ণসখা
বলে।
একা এসে একা বেঁচে একা যেতে
হবে।
আমার কিছুই নয় আমার নিজের।
দাসত্বের বেড়ি পরে বন্ধু সেজে
আছি।
অঙ্গরাজ নামে এক কৃতজ্ঞ চাকর-
অঢেল ঐশ্বর্যবতী গণিকার মতো
শৌর্য শক্তি বল সবই অন্যের
খোরাক।
ভীষ্মের পতন
আমি শুনেছি যখন,
মৃত্যু শুধু
শ্রেয় নয়, বেশ বুঝে গেছি,
সে আমার প্রেয়রই ঠিকানা।
ভীষ্ম : শোনো কর্ণ,
আমি নই
সেনাপতি, ভাল করে জানি
আগামী সকালে
তুমি যুদ্ধে ভাগ নেবে।
মৃত্যু নিয়ে
এত কথা কিন্তু তার আগে
আদৌ স্বাস্থ্যকর
নয়।
কর্ণ : আমিও তা বুঝি।
কিন্তু বহু দিব্য
বাণ যেমন স্বেচ্ছায়
অবাধে নিয়েছি আমি নিজের কবচে
শুধু তার
অভেদ্যতা দেখাব বলেই,
আজ এই যুদ্ধক্ষেত্রে,
স্বেচ্ছামৃত্যু যাঁর,
কী তিনি বোঝাতে
চান ভূপতিত হয়ে?
খেলার ছলে কি কেউ শহিদ হয়েছে?
খেলা ছাড়া আর কিছু এই যুদ্ধ
নয়
আমরা যারা ক্রীড়নক, সকলেই
জানি।
অর্জুনের বাণে
মৃত্যু, স্বর্গের আশ্বাস?
আপনার শরশয্যা
আমার এ বুকে
অন্য এক বীরগতি
এঁকে দিতে চায়।
সত্যিই কী পেতে
চাই অর্জুনকে মেরে?
কী আর প্রমাণ দেব নিজ
সামর্থ্যের?
যদি কোনো দিব্য বাণ অমরত্ব
দেয়,
কেন তাকে হতে হবে নিজের তূণের?
ভীষ্ম : সারথীর ছেলে, শোনো, এই ক্রীড়াভূমি
সাজিয়েছে
দুর্যোধন, বলো দেখি কেন?
শকুনির চাতুরিতে
আমি তুমি দ্রোণ
আমাদের নিয়ন্ত্রণ পেয়েছে সে
হাতে।
এই তার জারিজুরি, আর কিছু নেই।
অশ্বত্থামা কৃপ শল্য কেউ গন্য
নন।
আমাদের যদি না সে আয়ূধ হিসেবে
কোনোদিন পক্ষে পেত, যুদ্ধই হত
না।
আর এও বলে রাখি, হতে পারে
জানো,
যদিও তোমার কিছু প্রতিবন্ধকতা
রয়ে গেছে ভাগ্যদোষে, এড়াতে
পারোনি,
হারিয়েছ জন্মগত কবচ-কুন্ডল,
ধরিত্রীর রোষ আছে রথের চাকায়,
কুড়িয়েছ অনিবার্য
গুরু-অভিশাপ,
তোমার পতন কিছু অসম্ভব নয়,
তবু তুমি হতে পারো এ যুদ্ধের
গতি।
আমি নই, দ্রোণ নন, শ্রেষ্ঠ
অস্ত্র তুমি।
কর্ণ : হ্যাঁ তা জানি কুরুবর।
ভীষ্ম: এটুকুও জেনো
এ মোটেই ধর্মযুদ্ধ
নয়, এ হল আসলে
ন্যায়ের শোধন।
কর্ণ: জানি, জলের বদলে
রক্ত দিয়ে
ধোয়া হচ্ছে পৃথিবীর পুঁজ,
দিব্য অস্ত্র ছুরি
হবে যোদ্ধাদের হাতে,
বাসুদেব এরকমই
স্থির করেছেন।
নতুন শরীর
পাবে ধরিত্রীর মন,
এটুকুই রয়ে
গেছে গুরুত্ব খেলার।
দিকে-দিকে
আর্তনাদ-এত ভিড় কেন!
ভারহীন হয়ে
যাক পৃথিবীর দেহ
শুরু হোক
নতুনের, এই তিনি চান।
ব্যক্তিগত
ধর্ম নয়, ন্যায় কাম্য তাঁর।
শুধুমাত্র ভিন্ন-ভিন্ন শান্তির ধারণা
দুই পক্ষে যুদ্ধরত
এই মহারণে।
কেউ নন
পূন্যবান, কেউ নন পাপী,
ব্যক্তিগত আস্ফালন
সম্পৃক্ত হয়েছে।
কার কত পাপ
আছে, কে ছিল নির্দোষ
সেসব প্রশ্নের
আর অবসর নেই।
উনি চান দেখা দিক অন্য আধুনিক-
ফলের বদলে বীজ মুখর যেখানে।
ভীষ্ম: অন্য আধুনিক! নাকি পুরোনোই সেই
আরেকবার দেখা
দেবে নতুনের বেশে?
অভিমন্যু নামে
এক কিশোরের রূপ
যখন দেখেছি আমি মনে পড়ে গেছে
আমার আগের মুখ, যেন সে দর্পণ!
ওর মধ্যে
অনেকটাই দেবব্রত আছে!
কর্ণ : অবশ্যই অভিমন্যু নতুনের ছবি।
ওর সেই তেজ
আছে। ধনঞ্জয় নয়,
দেবব্রত
ভীষ্মকেই পড়ে যায় মনে।
কিন্তু এই
পরিসর ভীষ্মের হবে না।
একার সামর্থ্য
আজ বড় বেমানান।
সব ফল পচে
গেছে, বীজের সময়-
বাহুবল
হাস্যকর, যুগ-পুরুষের
হাতে তাই
অস্ত্র নেই, নারায়ণী সেনা
নিজের বিপক্ষে
রেখে যুদ্ধে নেমেছেন-
জীর্ণ এক নৌকো নিয়ে প্রাচীন
কান্ডারী।
কিন্তু কৃষ্ণ
একা নন, সত্যবদ্ধ নন,
ব্যক্তির সত্য
তো আজ শুধু অহমিকা।
বিষে বিষক্ষয়
হোক-এই তিনি চান।
যে কোনো
মুহূর্তে হাতে আয়ূধ নেবেন,
প্রয়োজনে
ছলনায় কোনো দ্বিধা নেই।
একা কেউ জিতে যাবে, এ আজ অলীক।
ব্যক্তিগত কীর্তি
নয়, এই পরিসরে
নির্ণায়ক হবে
শুধু জীবনের দাবি।
কোনো এক
জীবনের কথা সেটা নয়,
সব কিছু পণ
রেখে অগন্য জীবন
তাকিয়ে রয়েছে
আজ গোবিন্দের দিকে।
সব কিছু মুছে
যাবে, প্রশ্ন শুধু এই
কোনো ভীষ্ম
কোনো কর্ণ জ্বালানির বেশি
কিছুই কি পারবে হতে যজ্ঞের
আগুনে?
আমি বুঝি পান্ডবেরও ভূমিকা
কেবল
মাধবের ব্রতটিকে পূর্ণতা
দেওয়া।
ভীষ্ম : সকলেই তাই কর্ণ, সকলেই ঘুঁটি
ওই গোয়ালার
হাতে।
কর্ণ : সেটাই তো বলি।
তবুও তো
সামর্থ্যের প্রমাণ স্বরূপ
কিছু দাগ
কুরুক্ষেত্রে রেখে যেতে হবে।
গোবিন্দ যা
চান সেটা পূর্ন হলে হোক,
কিন্তু বন্ধু
সুযোধন যেন না বলেন
সারথীর ব্যাটা
তাঁকে ছলনা করেছে।
উনি চান আমি
ওঁর সেনাপতি হই।
কিন্তু গুরু
দ্রোণাচার্য, যোগ্য তো তিনিই।
রণাঙ্গনে আমি
যাব দ্রোণের অধীনে,
যদি তিনি হত
হন, তবে সেনাপতি।
যেন তেন
প্রকারেণ অর্জুনের বধ-
ওই এক লক্ষ্য স্থির
করেছে জীবন।
হয় আমি থেকে
যাব, নতুবা অর্জুন,
একই সঙ্গে
পূর্ণ হবে দুজনের পন,
কী বলেন গঙ্গাপুত্র?
সে তো অসম্ভব!
ভীষ্ম : কেন হবে অসম্ভব? কার ছেলে তুমি!
সূর্যের
প্রসাদ কেন সীমাবদ্ধ হবে?
জানো না কি
তুমি আজও নিজ পরিচয়?
কর্ণ : কুন্তীর সন্তান আমি, কানীন পান্ডব।
পেয়েছি সে
সংবাদ মাধবের মুখে।
এও জানি সেই কথা গুপ্ত কিছু
নয়,
জেনেছেন কেউ কেউ অনেক আগেই।
ভীষ্ম : সেনাপতি হয়ে তবে এ যুদ্ধে তোমাকে
কী করে তুমিই
বলো গ্রহণ করতাম?
জ্ঞাতিবধ তবু
হয়, সহোদর ভাই!
আমার কৌশলে
তাই যুদ্ধে নেই তুমি।
একেবারে
নির্বাসন দিতাম তোমাকে
কুরুক্ষেত্র
ভূমি থেকে, যদি সাধ্য হত।
কর্ণ : আপনার উদ্দেশ্য ভীষ্ম বুঝেছি ভালোই,
অপমান নয় জানি, মঙ্গল কামনা-
তাই আজও সরে আছি যুদ্ধভূমি
থেকে।
ভীষ্মের নেতৃত্বে হোক
ভ্রাতৃহত্যাপাপ
সেটা কিন্তু দেবব্রত আমিও
চাইনি।
কাকে বলে অভিনয়, শিখেছি তো
কিছু।
দ্রৌপদীর স্বয়ংবর- নাটকের
শুরু।
কর্ণকে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য তো
ছিলই।
আমার সে অপমান যদিও ভুলিনি
কিন্তু আজ ক্রোধ নেই, আজ বুঝে
গেছি-
দ্রৌপদীর জন্ম শুধু ভারতের
বুকে
কালোদের বিজয়ের প্রতীক
হিসেবে-
যজ্ঞের আগুন শুধু গালভরা কথা।
প্রেমে নয় প্রয়োজনে পার্থের
গলায়
মালা দিতে বাধ্য ছিল তাই
যাজ্ঞসেনী-
কৌরবের মৃত্যুবাণ পাঞ্চালের
হাতে।
নিজের ইচ্ছার তার মূল্য ছিল
না।
আজ শুধু অনুতাপ- পাশার আসরে
কেন যে আমিও ওকে আঘাত করলাম!
কে যে বলে প্রতিশোধ বিশুদ্ধ
আবেগ!
তার সঙ্গে মিশে থাকে
অনুশোচনাও।
যা কিছু ঘটেছে পরে, সব
নির্ধারিত,
এই যুদ্ধে নাটকের যবনিকা হবে।
কিন্তু যদি ওরা জানে কর্ণের
স্বরূপ,
পান্ডবের প্রতিক্রিয়া কী হবে বলুন?
কৌরব তো সয়ে নেবে ভীষ্মের পতন।
দ্রোণাচার্য হত হলে দুর্যোধন
তবু
যুদ্ধের সংকল্পে থেকে যাবেন
অটল।
অর্জু্ন যে
জ্বলে ওঠে আগুনের মতো,
বাতাস তো দেন তিনি,
সেই রণত্যাগী,
আমার জন্মের
কথা যদি জেনে ফেলে,
কিরীটীর
যুদ্ধসাধ সেখানেই শেষ-
কেশবেরও সাধ্য
নেই, উদ্যম ফেরান।
যুধিষ্ঠির স্বাদ
নেবে দাদার রক্তের,
তবে আর কেন
তাকে ধর্মপুত্র বলা!
ভীমসেন দূরে
ছুঁড়ে ফেলে দেবে গদা।
সহদেব নকুলের কথাই
ওঠে না।
পাঁচভাই ফিরে
সেই যাবে বনবাসে-
হাস্যকর হয়ে যাবে পাঞ্চালীর
পন।
যুদ্ধ ছাড়া জয়ী
হবে কৌরব বাহিনী।
ভীষ্ম : সে কি তুমি চাও কর্ণ? চাও তাই
হোক?
তুমিও তো
শিষ্য সেই পরশুরামের!
যদিও শিষ্যত্ব
পেলে কপটতা করে,
তবু তুমি অংশ
তাঁর সে কথা তো ঠিক।
অমন গুরুর চ্যালা, মহাদাতা
তুমি,
ওভাবে নিশ্চয়ই
তুমি বিজয়ী হবে না!
কর্ণ : না,
না! সে কি শোভা দেবে কর্ণের প্রতাপে?
যুদ্ধের
আকাঙ্ক্ষা থেকে কেন যাব সরে?
আমি জানি ভাই
হয় অর্জুন আমার।
অর্জু্ন তো
জানেই না ওর পরিচয়।
ওর শর নেব আমি কিছু না জানিয়ে,
আমার বাণের মুখে অশ্রু লেগে
থাক।
ভীষ্ম : কৃষ্ণ যেটা চেয়েছেন, জেনো তাই হবে,
তুমি আমি যা-ই
চাই, প্রভেদ হবে না।
বীরের কর্তব্য
শুধু আত্মাহুতি দেওয়া,
যত মহাবীর
হোক, শুধুই ইন্ধন,
ফলাফলে তার
কোনো অধিকার নেই।
ও কথা তোমার
বুকে গুপ্ত হয়ে থাক।
একাঘ্নীর চেয়ে
ঢের শক্তিশালী বাণ
ওই সত্য, তুমি বাছা প্রয়োগ
কোরো না।
কর্ণের সামর্থ্য শক্তি
অর্জুনের চেয়ে
ঢের-ঢের বেশি ছিল, এই কথা
জেনো
ভবিষ্যতে অবশ্যই সমর্থিত হবে।
মহাকাব্যে অন্য কিছু হয়ে থাক
লেখা।
গান্ডীবের ছিলা আর তোমার বিজয়
একাকার হয়ে যাক এই রণাঙ্গনে।
অর্জুনের অশ্রু আর কর্ণের
শোনিত
ভবিষ্যৎ বুঝে নেবে কেউ মিথ্যা
নয়।
তোমাদের খেলাশেষে নতুন ভারত
দুজনেরই নাম নিয়ে দেখা দিতে
পারে।
কর্ণ : মহাবলী, এই যদি ভবিষ্যৎ হয়,
এই যদি শ্রেয়
হয়, তবে তাই হোক।
শূর কর্ণ অস্ত্র হাতে এই
কুরুস্থলে
অর্জুনের প্রাণ নিতে প্রবেশ
করেছে,
দীপ্তিহীন কীর্তিহীন বঞ্চিত
হতাশ
নিস্ফলের দলে তার নাম লেখা হল,
লোকে শুধু সমকালে এই দেখে
যাবে,
ত্রুটিহীন অভিনয়, যে বোঝে
বুঝুক।
ভীষ্ম : কিন্তু তুমি প্রাণ দেবে অর্জুনের
হাতে,
যত ভাল অভিনয়
কর তুমি বাছা,
তোমার
সামর্থ্য ঠিক প্রাপ্য বুঝে নেবে।
হাতের ধনুক
তুমি নামাবে কী করে?
কর্ণ : যত অভিশাপ আছে, আশির্বাদ হোক,
সামর্থ্যের
সঙ্গে মিলে প্রতিবন্ধকতা
আমার পতনে তার
ভূমিকাটি নিক।
সুনিপুন অভিনয়,
ভীষ্মের মতোই।
ইচ্ছে করে
ভুলে যাব অস্ত্রদের নাম-
যেন সেই
অভিশাপ পরশুরামের।
যুদ্ধক্ষেত্রে
এক স্থানে কাদা আছে খুব-
রথ নিয়ে যাব
ঠিক সেখানেই আমি,
চাকাদু্টো বসে
যাবে মাটির কামড়ে।
হাতের বিজয়
রেখে রথের উপরে,
কর্ণ একা নেমে
যাবে নিরস্ত্রের বেশে-
অর্জুনের কাজ
হবে প্রাণটুকু নেওয়া।
সেই কালো
মেয়েটির পন পূর্ণ হবে-
বান্ধবীকে উপহার কালো ছেলেটির।
অর্জুন তো উপলক্ষ, আর কিছু
নয়।
বিজয় না
পরাজয়, মীমাংসা হবে না।
ভীষ্ম : কিরীটীর হাতে হবে নিরস্ত্রের বধ!
এই অসম্ভব কথা
ভাব কেন তুমি?
তার আগে বরং
সে আত্মঘাতী হবে।
কর্ণ : মনে তো হয় না দেখে ভীষ্মের পতন!
পিতামহ-বধ যদি
আজ তার হাতে
হয়ে থাকে
শিখন্ডীর আড়ালে দাঁড়িয়ে,
চিরশত্রু
কর্ণকে সে করুণা দেখাবে,
সম্ভাবনা আছে
বলে মনে তো হয় না।
অন্যায় সমর
যদি নিতান্ত না চায়,
তবে তাকে
দেওয়া যাবে পর্যাপ্ত কারণ।
আমার হাতেই
হোক অভিমন্যু বধ।
যদি তার প্রাণ
নিই কপটতা করে?
ভীষ্ম : অভিমন্যু...
কর্ণ : মরুক সে আমার হাতেই।
এমন মরণ হবে, অবসান
নয়-
চিরকাল ইতিহাসে নাম রয়ে যাবে।
কিন্তু
ন্যায়যুদ্ধে নয়, বাপের বিবেক
মরা ছেলে
একেবারে নষ্ট করে দিক।
প্রতিস্পর্ধা
নয় আর, ছেলের রক্তের
শোধ নিতে হিংস্র বাপ সব যাক
ভুলে।
তবু যদি দ্বিধা করে, কৃষ্ণ তো
আছেন,
কর্ণের কুকীর্তি সব স্মরণ
করাতে।
আমি যদি তাকে বলি, ‘শোনো
ধনঞ্জয়,
ছলের আশ্রয় নিয়ে এভাবে মেরো
না।
এমন কলঙ্ক তুমি কেন রেখে
যাবে?’-
যোদ্ধাকে তো করতে হয় অন্তিম
প্রয়াস-
কেশবের কন্ঠস্বর চাপা দেবে
তাকে।
অর্জুনের হাতে হবে কর্ণের
নিধন,
বধ নয় অবশ্যই, খুন হব আমি।
একাঘ্নী সম্পর্কে কিছু ভেবে
নিতে হবে।
পার্থ শুধু একা নয়, আরো ছয়জন-
লোকচক্ষে দায়ী হবে সমান সমান।
কুন্তীর অন্যায় সে তো সবার
প্রথমে।
অভিশাপ আছে গুরু পরশুরামের,
আর সেই ব্রহ্মশাপ রথের চাকায়।
ভিক্ষাপ্রার্থী দেবরাজ কবচের
চোর।
শল্যকে সারথি করে যুদ্ধে যাব
আমি,
সহদেব নকুলের মামা হন তিনি
আমাকে ঘৃণা করেন অন্তর থেকেই।
বাসুদেব স্বয়ং তো মূল ভূমিকায়-
আমার যে কোনো অস্ত্র ব্যর্থ
করে দিতে।
সপ্তরথী মিলে খুন বলা যেতে
পারে-
মঞ্চ যেন সেজেছিল ক্রিয়ার
ভিত্তিতে,
সেই অভিনয়ে কোনো অগৌরব নেই।
আমার পতনে শুধু কৌরবের শেষ,
অর্জুনের মৃত্যুতে তো সব
ব্যর্থ হবে।
কী বলেন কুরুবর, কেমন মতলব?
ভীষ্ম : ইচ্ছামৃত্যু বর নয়, খাঁটি
অভিশাপ!
সত্যিকার বর হত ইচ্ছাজন্ম
পেলে।
আজ এই
অন্ধকারে মনঃস্তাপ হয়,
সাধারণ যোদ্ধা
হয়ে যদি জন্মাতাম!
হাতে তুচ্ছ
বর্শা নিয়ে, অথবা বল্লম
এই যুদ্ধক্ষেত্রে যদি ভূমিকা
নিতাম !
যদি জীবনের শুরু অন্যভাবে হত
!
নগন্য বাপের ছেলে, সামান্য
মায়ের-
জীবিকার জন্য শুধু যুদ্ধ করে
যারা,
মুদ্রা নিয়ে নারী নিয়ে
টানাটানি করে,
ভীষণ যোদ্ধাকে দেখে পালিয়ে
বেড়ায়,
কখন যে মরে যায়, কত অনায়াসে!
এক দিব্য অস্ত্রে মরে হাজার
হাজার-
অধিকার নেই করে কোনো
প্রত্যাঘাত।
ওরা বেশ সুখে আছে, মৃত্যুভয়
নিয়ে,
অমরত্ব কাকে বলে বোঝেনি
জীবনে।
কাকে বলে শৌর্য-যশ পরোয়া করে
না।
বিরাট যোদ্ধার সেই কপাল কোথায়-
ইতিহাসে স্থায়ী নাম রেখে যেতে
হবে!
মৃত্যু সেও মৃত্যু নয়,
মৃত্যুর অধিক-
জীবন্মৃত শুয়ে আছি, তবু ক্ষান্তি
নেই।
এই জটিলতা নিয়ে যেতে তো হত
না।
কর্ণ : মহাবলী, আজ্ঞা দিন, আজ আসি আমি।
গঙ্গার প্রবাহ
হোক, সূর্যের সৌরভ,
আপনিই তো
বলেছেন সীমাবদ্ধ নয়।
টঙ্কারে যে
তির ছোটে পিছনে কি দেখে?
দেবব্রত বসুষেণ এই দুই নাম
একের চরিত্রে যেন দুই
অভিনেতা।
অন্য কোনো সুতো বেঁধে আমাদের
কেউ
উপহার যদি দিত বিধাতার হাতে
এ নাটক অবশ্যই যেত ভিন্নমুখে।
পৌরুষের দর্প আর ধর্মের বদলে
আমাদের মুখে যদি জীবনের ভাষা
মানুষের অভিপ্রায় অনুসারী
হত...
কিন্তু সেই সুযোগ তো নেই আর
আজ।
বরং ঘুমোতে যাই, রাত হল ঢের
।।
রক্ত দিয়ে ধোয়া হচ্ছে পৃথিবীর পুঁজ
ReplyDeleteযত অভিশাপ আছে, আশীর্বাদ হোক
সত্যিকার বর হতো ইচ্ছাজন্ম পেলে
বরং ঘুমোতে যাই, রাত হল ঢের,,,,,
চমকে দিয়েছে,,,,,,,