পুনরাধুনিক আমার কোনো পতাকা নয়। এটা মোটেই নয় যে, পুনরাধুনিক কবিতা লিখতে হলে আমার কবিতার অনুকরণ বা নকল করতে হবে, বা পুনরাধুনিক শব্দটা জেনে তবে আমার কবিতায় আসতে হবে। না, পুনরাধুনিক নিয়ে কিছু বলার অর্থ এই নয় যে, শুধু নিজের কবিতা নিয়েই কথা বলছি। না, আমার কবিতাই পুনরাধুনিক নয়। বরং বলা যাক, আমার কবিতাও পুনরাধুনিক। এবং নকল বা অনুকরণের কোনো সুযোগ পুনরাধুনিকে নেই। আমার বিশ্বাস, একেবারেই অন্য এবং নিজস্ব পথে একজন, বা অনেকজন, পুনরাধুনিকে এগোবেন, এমনকি হয়ত এগোচ্ছেন। এটাও বলে রাখা ভাল, পুনরাধুনিক কিন্তু কোনো গন্তব্য নয়, সে একটা কম্পাস, গন্তব্যকে দেখিয়ে দেয়। পুনরাধুনিক যে কোনো তত্ত্ব নয়, ব্যক্তিগত হলেও কারও একচেটিয়া নয়, একটা ভাবনা, এবং তা সঞ্চরণশীল, সেটাই এই আলোচনায় স্পষ্ট করতে চাই।
![]() |
মাইকেল মধুসূদন দত্ত |
পুনরাধুনিক, অর্থাৎ একজন কবির সম্পূর্ণ আধুনিক (আধুনিক অর্থাৎ সাম্প্রতিক বা সমসাময়িক নয়। যেমন, মৃগ আজ পশু নয়, শুধুই হরিণ। আধুনিক হল এক অবস্থা যেখানে একজন ব্যক্তিমানব তাঁর পূর্ণ সুষমায় দাঁড়ান। নিজের সঙ্গে ও নিজের পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে হেস্তনেস্ত মিটিয়ে তিনি তখন আর সম্ভ্রান্ত থাকেন না, তাঁকে প্রান্তিক বলাও তখন ব্লাশফেমি। উদাহরণ দান্তে আলিগিয়েরি। উদাহরণ মাইকেল মধুসূদন দত্ত। উদাহরণ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।) হয়ে ওঠার দিকে যাত্রা, এই ধারণা আমার মাথায় আসে ২০১০ নাগাদ। ততদিনে বাংলা কবিতার ধারাবাহিকতা সম্পর্কে যতই আবছা হোক, একটা ধারণায় পৌঁছতে পেরেছিলাম। কিছুটা হলেও বুঝতে পেরেছিলাম বিংশ শতাব্দীতে বাংলা কবিতা কোন পথে চলেছে, চলতে চেয়েছে, চলতে দেওয়া হয়েছে তাকে। এটা নিজের কাছে একটা দায় ছিল, কারণ আমি মনে করি নিজের ভাষার কবিতা সম্পর্কে একটা ঐতিহাসিক অবস্থান ও অবলোকন না থাকলে একজন কবিকে সিরিয়াসলি নেওয়া চলে না, কবিতা লেখার অধিকার তাঁর থাকে, কিন্তু পাঠকেরও থাকে তাঁকে সন্দেহ করার সমান অধিকার।
‘পুনরাধুনিক’ শব্দটিকে আমি বেছে নিয়েছিলাম, আবার ১৯
শতকীয় বা ২০ শতকীয় আধুনিকে ফিরে যেতে হবে এই অর্থে আদৌ নয়। তাহলে তো পুনর্জন্ম টাইম
মেশিনে চড়ে আগের জীবনে ফিরে যাওয়া হয়ে
যাবে, পুনরুজ্জীবন হয়ে যাবে আগের জীবন্মৃত অবস্থাতেই আবার মৃত্যুর জন্য ফেরত
যাওয়া। সেটা নয়। পুনরাধুনিক নতুন আধুনিক, নব্য আধুনিক, নিও-মডার্ন। রি-মডার্ন কখনই
নয়। ‘আধুনিক’ শব্দটা আমাদের বর্তমান সামাজিক দশায় সবচেয়ে পিপাসার শব্দ হতে পারে
বলে আমি মনে করি। আমাদের মধ্য থেকে আলো হারিয়ে যাচ্ছে, আশা হারিয়ে যাচ্ছে,
দুর্বোধ্য সময় আমাদের কদাকার মুখ দেখাচ্ছে। ঘাতকদের এই সময়ে একজন রামমোহন, একজন
বিদ্যাসাগর, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, এমনকি একজন সুভাষ চন্দ্র বসু থাকলে আমাদের
এই শিকড়হারা মনোভাব কি হত? প্রশ্নটা শিশুসুলভ। এখন তো তাঁরা ফিরে এলেও অপ্রাসঙ্গিক
হয়ে যাবেন। এই পরিসর তাঁদের নয়। কলকাতার রাজপথে বা মালদহের মাঠে চরে বেড়ানো এক
ব্রন্টোসরাসের মতোই তাঁরা আজ অলীক।
নতুন আধুনিক ছাড়া, একটা
নবজাগরণ ছাড়া আর কী হতে চাইতে পারেন এমন অবস্থায় একজন সভ্য-শিক্ষিত মানুষ? আমাদের
এখন লন্ডন নয়, একটা ফ্লোরেন্স প্রয়োজন। একজন কবি আর কোন শব্দের দিকে ‘আধুনিক’-এর
চেয়ে তৃষ্ণার্ত হতে পারেন? তিনিই তো হবেন পুনরাধুনিক কবি। কিন্তু আধুনিক শব্দটাকেই
তো আমাদের সমাজ আর বিদ্যায়তন বিগড়ে দিয়েছে পুরোপুরিভাবে। আজ একটা নবজাগরণ
ছাড়া আমাদের রক্ষা নেই। সামাজিকভাবে সেটা সম্ভব নয়, হয়তো, কিন্তু একজন মানুষ
ব্যক্তিগতভাবে তো আধুনিক হয়ে উঠতে পারেন, বিশেষ করে তিনি যখন নতুন শতাব্দীর কবি। অধুনান্তিক যাপনের মধ্যে পুনরাধুনিক
অবশ্যই স্বাভাবিক নয়। হ্যাঁ, পুনরাধুনিক একজন ব্যক্তির বানিয়ে নেওয়া জিনিস হতে
বাধ্য, তা একজন ব্যক্তির নিজের স্বাভাবিকতার সঙ্গেই বরং এক লড়াই। যাপনটা
অধুনান্তিক, আকাঙ্ক্ষায় আধুনিক। অর্থাৎ,
অধুনান্তিক যাপনকে অতিক্রম করার নাম পুনরাধুনিক। অধুনান্তিক কিছু লক্ষণ যদি থেকেও যায়, সেগুলো হবে মুছে যেতে থাকা
পায়ের ছাপ।
ব্যক্তিগতভাবে কবিতার ইতিহাসের দিকে তাকানো খুব
জরুরি। সেটা আমরা ভুলতে বসেছি। কনস্টান্টিনোপোলের ইতিহাসে বর্বরদের যে ভূমিকা,
আমাদের কবিতায় সমালোচক ও সাহিত্যের ইতিহাসকারদের কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রায় সেই
ভূমিকাই দেখতে পাই। বিংশ
শতাব্দীর বাংলা কবিতার এক বিরাট অভিশাপ হল রবীন্দ্রনাথের কবিতার সাপেক্ষে অন্যান্য
দিকপালের কবিতার প্রতি বিদ্যায়তনের ঋজু অবস্থানের অভাব। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
পেরেছিলেন ব্রিটিশ আধুনিক, ব্রিটিশ রোমান্টিকতা, পদাবলী, এবং উপনিষদের মিলনে এক
অপরূপ বাংলা কবিতায় পৌঁছতে। সে এক অন্য আধুনিক। সেখানে শেলি-কীটস এবং
জ্ঞানদাস-গোবিন্দদাস এক হয়ে যান।
শৃঙ্গাররস এবং ভিক্টোরিয়ান নৈতিকতা সেখানে ঝগড়া করে না। ম্যাথু আর্নল্ড এবং বিদ্যাপতির কোনো বিরোধ নেই সেখানে। ভানু সিংহ হাত
রাখেন নিবারণ চক্রবর্তীর কাঁধে।
![]() |
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর |
কিন্তু বিংশ শতাব্দীর বাংলা কবিতার বিদ্যায়তনিক তথা
প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাখ্যার মধ্যে যত ঢুকবেন, দেখতে পাবেন, তিনের দশকের কবিতাই হয়ে
উঠতে চেয়েছে বাংলা কবিতায় আধুনিকের ভিত্তিভূমি। বিদ্যায়তন চেয়েছে তিনের দশকের
কবিতাই আধুনিক কবিতার পরাকাষ্ঠা হয়ে উঠুক।
সমস্যাটা হল, সে ওই দশকের আধুনিককে হাশিল করতে চেয়েছে রবীন্দ্রনাথের ‘অনাধুনিকতা’
দাবি করে। ছলে-বলে-কৌশলে বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠা করতে চাওয়া হয়েছে, কালের কষ্টিপাথরে
রবীন্দ্রনাথ ঠিক ‘আধুনিক’ নন। একজন জীবনানন্দ দাশ, বিষ্ণু দে, বা সুধীন্দ্রনাথ
দত্ত, এমনকি সমর সেনের কবিতায় আধুনিক যেভাবে ধরা দেয়, রবীন্দ্রনাথের কবিতায় নাকি
দেয় না। কবিগুরুর উপনিষদে অধিকার, তাঁর আশ্চর্য আভিজাত্য, ব্রাহ্ম উত্তরাধিকার,
নাছোড় রোমান্টিকতা, সর্বোপরি তাঁর পরম আস্তিক্য নাকি আধুনিক কবি হিসেবে তাঁকে
মান্যতা পেতে বাধা দেয়। অসংখ্য মূল্যবান প্রবন্ধ রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লেখা হয়েছে।
অসংখ্য বই। কিন্তু, সভয়ে বলছি, তাঁর অন্যান্য দিকে পর্যাপ্ত
আলোকপাত হলেও, আবু সায়ীদ আইয়ুব, নীরদ সি চৌধুরী, এবং কিছুটা শঙ্খ ঘোষ ছাড়া আর কেউ
রবীন্দ্রনাথকে রবীন্দ্রনাথের নিজের আধুনিকের ধারণায় পরখ করতে সচেষ্ট হননি গত ৫০
বছরে। বরং শিবনারায়ণ রায়ের মতো একজন বিদগ্ধ মানুষও তাঁর
প্রবন্ধে গ্যেটের সঙ্গে তুলনা করে রবীন্দ্রনাথকে হেয় করেছেন, তাঁর সাহিত্যে
রক্তমাংসমলমূত্রের অভাবই যেন রবীন্দ্রনাথকে প্রতিবন্ধী করেছে আধুনিকের দরবারে।
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই কবিপুত্রটি যে কিছুতেই মানুষের বিছানা এবং টয়লেটটাকে
দেখাতে চান না, কিছুতেই সত্য-শিব-সুন্দরে বিশ্বাস হারাতে চান না, এটাই যেন
পর্যাপ্ত কারন তাঁর প্রতি ঘোর অবিশ্বাস রাখার।
সেটা স্বাভাবিক ছিল কি? হতে পারে। রবীন্দ্রনাথ
তাঁর সাহিত্যজীবনের সোনাঝরা পর্বটা কাটিয়েছেন দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধের আগে। সেই
পরিসরটা অন্য ছিল। সেই পরিসরের অভিজ্ঞতা ও স্মৃতিতে খারাপ লোকেরা ছিলেন, কিন্তু
শয়তানরা ছিলেন না। নেপোলিয়নের স্মৃতি ছিল, কিন্তু হিটলারের অভিজ্ঞতা নয়। লর্ড
ক্লাইভের কাহিনি ছিল, কিন্তু মুসোলিনির নয়। সেখানে প্রাকৃতিক মন্বন্তর ছিল,
মানুষের হাতে তৈরি পরিকল্পিত দুর্ভিক্ষ ছিল না। সিপাহী বিদ্রোহ ছিল, কিন্তু
কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প ছিল না যেখানে মানুষের হাড় দিয়ে বানানো হবে সিগারেট হোল্ডার।
মানুষ যে প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি, ঈশ্বর যে তাঁর নিজের অবয়ব দিয়েছেন মানুষকে,
মানুষের উপরে কোনো সত্য থাকতে পারে না... দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধ এসে সেই ধারণাকে
চুরমার করে দিয়ে চলে গেল। একটা নীল গ্রহ যেন তার সবটুকু আস্থা নিয়ে তলিয়ে গেল। সেই
গ্রহের বিরাট একটা অংশে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সর্বস্ব রেখেছিলেন। এর ফলেই
রবীন্দ্রনাথকে বিশ্বাস করা চুরমার দুনিয়ার পক্ষে মুশকিল হল, বিভিন্ন পশ্চিমী দেশে
যুদ্ধকাতর পাঠকের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের জনপ্রিয়তা কমে গেল, বইয়ের বিক্রি
লক্ষ্যণীয়ভাবে হ্রাস পেল। আইনস্টাইন, চ্যাপলিন, আঁদ্রে জিদ, রমাঁ রলা, ব্রেশট, হারমান হেসের মতো
চিরকেলে লোকেরা তাঁর সুনাম করলেও, এমনকি লোরকা, বুনুয়েলের মতো দুর্দমদের কাছে তাঁর
সমাদর হলেও, রিলকে, টমাস মান, কাফকার মতো সাহিত্যিকের কাছে তাঁর ‘অচল’ আশাবাদের
কোনো মর্য্যাদা হল না। আন্তর্জাতিক সময়টা কিন্তু রিলকে, মান আর কাফকারই অনুগত ছিল।
আমাদের এখানেও সময়ের ধারণা এসে দাঁড়াল
রবীন্দ্রনাথ এবং তাঁর বিচারের মাঝখানে। তিনের দশকের কবিরা এসে পড়লেন আন্তর্জাতিক
সময়ের প্রতি তাঁদের আনুগত্য নিয়ে, আন্তর্জাতিক কবিতার গতি তাঁদের কবিতায় দেখা দিল। এই ধারণা মহাসমারোহে প্রতিষ্ঠিত হল যে, আধুনিক কবিতাকে হতে হবে নাগরিক ও কুটিল, তার
মধ্যে পল্লী ও প্রসন্নতা থাকবে না, সে অবশ্যই মানুষের অন্তর্গত অন্ধকারকে উদযাপন
করবে, শান্তিকল্যাণের ধারণাকে মাইলের পরে মাইলে উপহসিত হতে হবে। প্রেম
নয়, পাপ ও কদর্যতার বিশ্লেষণ হয়ে উঠল কবিতার উপজীব্য। মূল সুর হল বিতৃষ্ণা।
উদ্বেগ, উৎকন্ঠা, বিপন্নতা, অনিশ্চয়তা হয়ে উঠল অপরিহার্য ‘গুণ’। কবি হলেন অনিকেত।
তিনি যদি একজন নিরাশ্রয়, শিকড়হীন, ব্যর্থ নাগরিক মানুষ হন, হন নেশাখোর, এমনকি
উন্মাদ, কামুক, অসামাজিক... তাহলে যেন তাঁর কবিস্বভাব সবচেয়ে মান্যতা পায়। এই
মানসিকতা বাংলা কবিতায় ঢুকে এল বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদে শার্ল বোদলেয়ারের হাত ধরে।
রবীন্দ্রনাথ নন, মাইকেল নন, তথাকথিত আধুনিক বাংলা কবিতার বিগ্রহ হয়ে উঠলেন শার্ল
বোদলেয়ার, আর্তুর র্যাঁবো, এবং প্রথম পর্বের টি.এস. এলিয়ট। আধুনিক ব্যাপারটা আর
একক ব্যক্তির থাকল না, তার উপরে চাপিয়ে দেওয়া হল বেশ কিছু মান্য এবং মূলহীন শর্ত।
আধুনিক আর নাগরিক অবক্ষয় এক হয়ে দেখা দিল, বাংলার
গ্রাম তার বাস্তবতা নিয়ে বাংলা কবিতা থেকে বিদায় নিল। গ্রামীন প্রসন্নতা
অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেল, কিছু কিছু কবি অবিশ্যি গ্রামবাংলাকে শহরের পাঠকের সামনে কিছু
একঘেয়ে ছবি হিসেবে নিয়মিত তুলে ধরলেন (যেমন মেঠো রাস্তা, সাদা পথ, বাউলের মাজার,
শান্ত পুকুর, কচুরিপানা, হাঁসের ডাক), এবং প্রতাপশালী পত্রিকা সেগুলোকে ছেপে
চললেন, গ্রামের একটা মোহময় রূপ এঁরা জারি রাখলেন, গ্রামের খাঁটি চেহারা ও
পল্লীসমাজ নয়।
সম্মানিত ধারাটি একান্তভাবেই নাগরিক হয়ে থাকল। কিছু
কবির একটা বিশেষ ইমেজ তৈরি হল, জীবনে তাঁরা ব্যর্থ বলেই যেন কবিতায় তাঁরা দেবতা। জীবন কি
ব্যর্থ হতে পারে? জীবন কি সফল হতে পারে? কিছু কবির বোহেমিয়ানপনার প্রতি এই ধারণা ও
আসক্তি আজও মরেনি। এখনও আমার সমবয়সী কবিকে দেখি নিজের গাঁজা, মদ নিয়ে গর্বিত, যারা
নেশা করে না তাদের তিনি কবি মনে করেন না। একটু দাড়ি থাকবে, পোশাক-আশাক হবে অগোছালো
ময়লা, হাতের নখ কাটা হবে না, একটা মলিন গিটার নিয়ে যে কোনো সিঁড়িতে বসে পড়লেন...
অনেকেই ভাবছেন এই তো এক সত্যিকারের কবি! এই তো কেমন ইনি নিজের যাপন দিয়ে কবিতা
লিখছেন! কেমন নিজের অচেতন খুঁড়ে সুররিয়াল আনছেন! যেমন অনেকে কবিতার পত্রিকার নাম
রেখেছেন ‘উন্মার্গ’, ‘রসাতল’, ‘দুর্বিপাক’, ‘পাগলাগারদ’... ইত্যাদি। এতে আধুনিক
অনেক দূরে সরে গেছে। এইসব নামকরণ পোস্টমডার্ন মানসিকতাকেই
দর্শায়, আধুনিককে ধর্ষায়। রবীন্দ্রযুগের পত্রিকাগুলোর নামকরণের (‘ভারতী’, ‘সাধনা’,
‘সবুজপত্র’, ‘ভারতবর্ষ’ ... এমনকি ‘কল্লোল’) পাশাপাশি এই নামগুলোকে বসালেই পরিসরের
বদলটা চোখে পড়বে, এবং চেতনার বাঁকবদলটাও। আজও চরম ঋণাত্মক নামকরণ নিয়ে পত্রিকা
প্রকাশিত হচ্ছে। পত্রিকার নামকরণ থেকে কিন্তু অনেকটাই বোঝা যায় তার শ্বাসপ্রশ্বাস
কীরকম। সম্পাদক যদি তাঁর পত্রিকার নাম রাখলেন ‘সায়নাইড’,
পাঠক সেখানে পরাগরেণু না-ও পেতে পারেন।
![]() |
জীবনানন্দ দাশ |
যাই হোক, জীবদ্দশায় অবহেলিত হলেও তাঁর মৃত্যুর
পরেই রবীন্দ্রনাথের প্রতিস্পর্ধী হিসেবে খাড়া করা হল জীবনানন্দ দাশকে। অনেকের কাছে
রবীন্দ্রনাথ তখন বাতিল এক কবি, আর জীবনানন্দই হলেন উপাস্য ও অনুসরণীয়। অথচ, প্রথম
জনের তুলনায় দ্বিতীয়জন এক কিংবদন্তি ছাড়া কিছুই নন। যদি তাঁর লোভনীয় মিশ্রকলাবৃত্ত
তুলে নেওয়া হয়, ব্যাবিলন-মিশরের হাতছানি থেকে চোখ ফিরিয়ে নেওয়া হয়, জীবনানন্দর
অসংখ্য কবিতা তাঁর সমকালীন বিপন্ন ও বিষন্ন পৃথিবীর কেতাবি ধারাবিবরণী ছাড়া আর
কিছুই থাকে না। ভাবের নিরিখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একমাত্র ‘দুঃসময়’ কবিতাটিই
যথেষ্ট হবে জীবনানন্দর ওই কবিতাগুলির এবং তথাকথিত কালচেতনার ভার সামলাতে। অবশ্য
জীবনানন্দর চেয়ে স্টাইল-সচেতন কোনো কবি সম্ভবত আসেননি বাংলা কবিতায়। তাঁর স্টাইলই
‘তিনি’ হয়ে উঠেছিল। আন্তর্জাতিক কবিতার প্রতি জীবনানন্দর সচেতনতা অগাধ। জীবনানন্দ আন্তর্জাতিক কবিতার নিবিষ্টতম পাঠক
ছিলেন। কতখানি গভীরে গিয়ে তিনি বোঝাপড়া করতে চেয়েছিলেন বাংলা কবিতার সঙ্গে, সেটা
তাঁর গদ্যগ্রন্থ ‘কবিতার কথা’ পড়লেই বোঝা যায়। রবীন্দ্রনাথের আধুনিক সম্পর্কে
জীবনানন্দের নিঃসংশয় উক্তি ওই গ্রন্থে আছে।
জীবনানন্দ দাশ নিজের একটা স্টাইল-পৃথিবী
চেয়েছিলেন বাংলা ভাষায়, যেটা হবে রবীন্দ্রনাথের ভুবন থেকে প্রশ্নাতীতভাবে আলাদা।
তিনের দশকে একমাত্র জীবনানন্দ দাশই সেটা করতে পেরেছিলেন, বাকি সকলের লেখাতেই
রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতি না হোক মুখর অনুপস্থিতি অনুভব করা যায়। তবে, আমি দৃঢ়ভাবে
বিশ্বাস করি জীবনানন্দ দাশের চেয়ে বড় ভিলেন বাংলা কবিতার গত ৫০ বছর পায়নি। এক
অপরূপ শয়তান উনি। এক অনিচ্ছুক মেফিস্টোফিলিস। উনি বাংলা কবিতায় না চেয়েও একইসঙ্গে
দুটো বিষ ঢুকিয়ে দিয়েছেন। একটা বিষ হল পরোক্ষ বোদলেয়ারীয় আবহাওয়া। বোদলেয়ারকে আমরা
পেয়েছিলাম বুদ্ধদেব বসুর হাত থেকে, কিন্তু সেটা প্রত্যক্ষ পাওয়া, তার ঢের আগেই
তিনি অনুপ্রবেশ করেছেন জীবনানন্দর কবিতার রন্ধ্রে রন্ধ্রে, প্রত্যক্ষ প্রভাব
ছাড়াই, এবং আমাদের মধ্যে ঢুকে গেছে আলোর বিপরীতে মৃত্যুর নরম কোলে শুয়ে পড়ার
প্রবণতা, জীবনবিমুখতা, যেন অন্ধকারের শুকনো গন্ধহীন যোনি আমাদের গন্তব্য, সে লিঙ্গ
নিয়ে হোক বা জিভ নিয়ে। এতটা বাবুগিরি ও বিনাশপ্রিয়তা নিয়ে কাজ করতে অন্য কোনো
দেশের কবি ভালবাসে না, যতটা আমাদের নাগরিক কবিকূল। এর অনেকটাই কারন তাঁর অত্যন্ত
জরুরি ও আন্তর্জাতিকমানের উপন্যাসগুলোকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে জীবনানন্দর কবিতাকে আঁকড়ে
ধরা। ওঁর উপন্যাস বাংলা সাহিত্যের যতটা
উপকার করতে পারত, সেটা করতে দেওয়া হল না। কবিতা কিন্তু
ঠিক ততটাই ক্ষতি করেছে। বাঙ্গালি নাগরিক কবিদের মন থেকে আধুনিককে ধুয়েমুছে সাফ করে
দিতে পেরেছে। কবিরা অহেতুক ঢলে পড়েছেন মৃত্যু অথবা মোহ, যে কোনো একটা দিকে অনেক
ভরসা নিয়ে।
আরেকটা বিষ হল মধ্যবিত্ত মানসিকতার জয়জয়কার।
বাংলা কবিতার ধর্মনাশ করেছে মধ্যবিত্ত স্বভাব। আমরা যে
মাঝারিয়ানা নিয়ে এত হাহুতাশ করি, সেটার অনিবার্য কারন আমরা সকলেই মনে মনে মাঝারিকে
নিজেদের লেপ-তোশক ভাবি। আমরা মার্সিডিজ এবং ভিখারির কাঁথা, দুটো দেখলেই সঙ্কুচিত
হই। আমরা অজ গ্রামে অ্যাট হোম ফিল করি না, আমরা মেট্রোপলিসেও এলিয়েন। এটাই জীবনানন্দ দাশ
তাঁর মরণোত্তর মহিমায় আমাদের দান করেছেন।
জীবনানন্দ যতই বেবিলন আর মধ্যপ্রাচ্যের রক্তিম সুরার খ্বাব দেখুন, বরিশালের
হৈমন্তী ভুবন তাঁকে ঘিরে থাকুক, সেটা শেষ অবধি আমাদের রোদ্দুরে মেলে দেওয়া
লেপ-তোশকের বাইরে নয়। তাঁর অসম্ভব মেধা-মনীষা-আবেগ নিয়ে তিনি শেষ অবধি আমাদের
সকালের খবরের কাগজটাকে বিশ্লেষণ করতেই শিখিয়েছেন, আর দৃশ্য নামক ঘটনায় ভদ্র ও বাবু
হয়ে উঁকি দিতে।
এবং জীবনানন্দর যে অসংখ্য ভক্ত রয়েছেন, যারা
তাঁদের পত্রিকার নাম রাখেন ‘বিভিন্ন কোরাস’ বা ‘নকটার্ন’, তাঁরা বোঝেন বলে মনে হয়
না, কিন্তু, ঘটনা হল, জীবনানন্দ সেটা বুঝতেন। এই এক বোধ যা আসলে বেদন, তাঁর মধ্যে
কাজ করেছিল, এটা আমি নিজের বোধ থেকে টের পাই। এটা সম্ভবত রবীন্দ্রনাথের চেয়েও
দুর্লঙ্ঘ্য পাঁচিল ছিল তাঁর সামনে। হাতে নিয়ে দেখেছেন চাষার লাঙল, বালতিতে টেনেছেন
জল... ঠিক আছে, কিন্তু কেন? কারণ তাঁর জগতটা বরিশালের ক্ষেত এবং কলকাতার রাজপথের
মধ্যে তো বটেই, রবীন্দ্রনাথ-ইয়েটস এবং নজরুল-গোবিন্দচন্দ্র দাশের মাঝখানে বেমানান
হয়ে ঝুলছে। জীবনানন্দ না পেরেছেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত হতে, না পেরেছেন ঈশ্বরচন্দ্র
গুপ্ত হতে।
এবং নিঃসংশয়েই এই কথা বলা যায় যে, জীবনানন্দ দাশ
লিখিত ‘আট বছর আগের একদিন’ (আত্মহননের যেন কারণ লাগে না। মরে যাওয়ার ইচ্ছা যেন
সবচেয়ে মাদকতাময়।) হল বাংলার প্রথম পোস্টমডার্ন কবিতা, জীবনানন্দ দাশ প্রণীত
‘সাতটি তারার তিমির’ কাব্যগ্রন্থটি তার নামকরণ (নামটাই যা বলার বলে দেয়) থেকে শুরু
করে প্রতিটি কবিতার প্রতিটি শব্দে বাংলার প্রথম পোস্টমডার্ন কাব্যগ্রন্থ। এই একটি
কাব্যগ্রন্থই বুঝিয়ে দেয় উত্তর-উপনিবেশ এবং পোস্টমডার্নকে আমাদের এখানে আলাদা করার
উপায় নেই। বিশ্বযুদ্ধের আঘাত, এবং স্বাধীনতার অব্যবহিত পূর্ব এবং পর অবধি যে
দেশব্যাপী রক্তপাত, খোদ ভারতবর্ষ নামক ধারণাটিরই একাধিক দেশে খন্ড খন্ড হয়ে যাওয়া,
বন্যার মতো ঢুকে আসা উদ্বাস্তুর দল আমাদের চেতনা থেকে ব্রিটিশের কাছ থেকে আদায় করে
নেওয়া আধুনিকের সবটুকু আলো শুষে নিয়েছিল। চিরকালীনতার,
আদর্শের, সনাতনের এমনকি ঋজু জীবনদর্শনের সাময়িক গ্রস্ত হওয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিল
না।
তিনের দশক থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল বাংলা কবিতার
পোস্টমডার্ন পর্ব। দেশভাগের পরে তার সঙ্গে যুক্ত হল উত্তর-উপনিবেশের খোয়ারি।
সত্যিই রবীন্দ্রনাথ এই পরিসরে অনেক দূরের এক নক্ষত্র, তাঁকে সম্ভ্রমের সঙ্গে
অবলোকন করা চলত, কিন্তু তাঁকে স্পর্শ করার আঙ্গুলগুলোয় তখন কুষ্ঠরোগের লক্ষণ। বরং
শার্ল বোদলেয়ার এই পরিসরে একজন জাগ্রত দেবতা। র্যাঁবো একজন দেবদূত।
জীবনানন্দ দাশই এই পরিসরের ভাষ্যকার। বাংলার প্রথম পোস্টমডার্ন কবি। সেইসঙ্গেই একজন
প্রতিনায়কের মোহময়তা তাঁকে ঘিরে নিয়েছে। রবীন্দ্রনাথকে পেরিয়ে তাঁর প্রভাব বিস্তৃত
হল পঞ্চাশের দশকে। আলোক সরকার, শঙ্খ ঘোষের মতো কবিরা থাকলেন সুদূর
অভিজাত লাইট হাউসে। ‘শতভিষা’ পত্রিকা আধুনিকেরই সাধনা জারি রেখেছিল, কিন্তু
রাবীন্দ্রিকতা অনুসরণ না করলেও তাকে অতিক্রম করতেও পারেনি, শেষ অবধি শুদ্ধ কবিতা। আর
স্বীকারোক্তিমূলক মিশ্র হাইব্রিড কবিতার মহারথীরা বোদলেয়ারীয় তথা জীবনানন্দীয়
রক্তকণিকাগুলোতে আরো দিলেন অক্সিজেন। সেটা গড়াল ছয়ের দশক অবধি। ছয়ের দশকের সাহিত্য
আন্দোলনগুলো... যেমন ‘হাংরি’ বা ‘ধ্বংসকালীন’... আদৌ আধুনিক ছিল না। ওগুলো একান্তই
পোস্টমডার্ন আন্দোলন ছিল।
আধুনিকে কোনো সাহিত্য-আন্দোলন হয়ই না। কখন একজন
কবিতালেখক আরো কিছু কবিতালেখকের সঙ্গে জোট বাঁধার কথা ভাবেন, ভাবতে চান? তখনই
ভাবেন যখন তাঁর একার উচ্চারণ তাঁর নিজের কাছে পর্যাপ্ত নয়। তিনি নিজেকে যথেষ্ট
ভাবছেন না, কিছু সমস্বর খুঁজছেন, একটা ‘-ইজম’ চাইছেন নিজের অগভীরতাকে আড়াল করতে। রাতের অরণ্যে যেমন অনেক নেকড়ের ডাক বাঘকে আড়াল করতে
চায়, পারে না। সেই বাঘ হাজির থাকতে পারে, বা অনুপস্থিত, ডাক আড়াল হয় না। একজন প্রকৃত আধুনিক কবি বা শিল্পী তাঁর সাদা কাগজ
ও সাদা ক্যানভাসের সামনে একা। সেখানে একটা ‘দুঃসময়’ লেখা হতে পারে, বা একটা
‘গের্নিকা’ আঁকা হতে পারে, কিন্তু তাঁর একমাত্র দায় তাঁর নিজের সৃষ্টির প্রতি।
সমাজ তাঁর সৃষ্টিতে স্থান অবশ্যই পাবে, কিন্তু সেখানেও তিনি শুধু নিজের হয়েই কথা
বলবেন। তাঁর নিজের মধ্যেই আছে তাঁর নিজের পৃথিবী।
বিশ
শতকের শেষের দিকে যে উত্তর-আধুনিক আন্দোলন বাংলা কবিতায় দেখা দেয়, সে আসলে ছিল
ইলেকট্রিসিটির বদলে রেড়ির তেলের আলো জ্বালানোর প্রয়াস। আর, ২০০০-এর সূচণার আগে-পরে
প্রত্যক্ষভাবে যে পোস্টমডার্ন আন্দোলন আমাদের কবিতায় হয়েছিল, যা আদতে এসেছিল বিদেশ
থেকে, যার সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছিল অভেদ, মুক্তসমাপ্তি, বহুরৈখিকতা এবং বিদিশার মতো
ভাবনা, সে আসলে ছিল বাংলা কবিতায় প্রথম সচেতনতা এই আবহাওয়াটির প্রতি। কিন্তু একটা
সমস্যা ছিল। ওঁরা পোস্টমডার্নকে ভারতীয় দর্শনের আলোয় মহিমান্বিত করতে চেয়েছিলেন। তার
সঙ্গে যোগ করতে চেয়েছিলেন উপনিষদের অভেদের ধারণা। তার মধ্যে আনতে চেয়েছিলেন
অফুরাণের বৈদান্তিক সম্ভাবনা। তাকে বলতে চেয়েছিলেন অনন্ত সম্ভাবনার পরিসর।
উদ্দেশ্যের দিক থেকে সেটা ঠিক আছে, কিন্তু পোস্টমডার্নের চরিত্রের দিক থেকে নয়।
পোস্টমডার্নে কোনো মহিমার সুযোগই নেই। কেওসের দিকে যাওয়া সভ্যতার ধর্ম নয় (বাইনারি
অপোজিশনের অসভ্যতা-কে যদি আপনি অপর হিসেবে স্নেহ করেন, বলার কিছু নেই।), যদিও তাকে
যেতেই হয়, তাকে ফিরেও আসতে হয়।
পোস্টমডার্ন পরিসরের কবিতাকে ভবিষ্যতের কবিতা বলা
চলে না। ভবিষ্যতের কবিতা একটা মিথ ছাড়া কিছু নয়। এবং কোনো
ব্যক্তিকে বা গোষ্ঠীকে পোস্টমডার্নের প্রবর্তক ভাবলে চরম তাত্ত্বিক ভুল হবে। পোস্টমডার্নের কেউ প্রবর্তক হতেই পারেন না। পোস্টমডার্ন একটা অবশ্যম্ভাবী সামাজিক পরিস্থিতি।
একজন কবির কলমে তা ধরা দিতে পারে মাত্র, ঠিক যেমন জীবনানন্দর কলম বরিশালের
নিসর্গের বদলে কলকাতার রাত, কুষ্ঠ, ও হাইড্র্যান্টকে বেছে নিয়েছিল। মজার
কথা হল, নব্বইয়ের দশকে এসে পড়া পোস্টমডার্ন কবিতার আন্দোলনটি কিন্তু বাংলা কবিতায়
বোদলেয়ারীয় আবহাওয়ার অবসানে বিরাট ভূমিকা নিল। এঁদের কবিতা নাগরিক এবং জীবনানন্দীয়
নয়। এঁরা চরম ভাষাসচেতন কবি, সমাজসচেতনতা দিয়ে এঁদের ব্যাখ্যা হবে না, বাংলা
কবিতার ভাষা এঁরা অনেকখানি বদলে দিয়েছেন, বাংলা কবিতা সেইজন্য ওঁদের কাছে চিরঋণী
হতে বাধ্য।
তবু, প্রতিষ্ঠানের প্রতাপের ফলে, আজ এই ২০১৫-এ
বাংলা কবিতায় বরং সেই ১৯৩০-এর দশকে এসে পড়া পোস্টমডার্ন ধারাটিই নাগরিক কবিতার
প্রতিনিধিত্ব করছে। সেখানে বিষাদ, আত্মকন্ডুয়ন এবং গ্লানিই হল বড় কথা। সমাজের দিকে
তাকালে এই কবিরা শুধু মানুষের ভিড়ই দেখতে পান, আর ক্রন্দন শুনতে পান। নিজেরাও
কান্নার ভান করে কাঁদেন। এঁরা কবিতার চেয়ে বিষাদের নির্মাতা। এঁরা বৃহত্তর সমাজ
থেকে বিচ্ছিন্ন, কিন্তু প্রতিষ্ঠানের প্রতাপাশ্রয়ী।
আর তার পাশাপাশি বয়ে চলেছে আবহমান লিরিকের একটি
ধারাও।
‘নতুন কবিতা’-র, তথা অতিচেতনার কবিরা এখন সেই
ধারায় সবচেয়ে একনিষ্ঠ মাঝি। এই ধারায় আনন্দটাই আসল রাজা, বিস্ময়ই একমাত্র সম্পদ। এঁরা
নিজের কাজটা সম্পূর্ণ সৎভাবে করেছেন, করছেন। এঁরা সমাজের বদলে নিসর্গকে উপজীব্য
করেছেন, অথবা রোমান্টিক যাপনকে। এই লিরিক অন্য লিরিক, এর গুণ আন্তর্জাতিক, বাংলা
ভাষার অলস সীমাকে এঁরা বারবার পরীক্ষার মুখে ফেলেছেন। এঁরাই পদাবলী ও রবীন্দ্রসঙ্গীতের
সার্থক উত্তরাধিকার বহন করছেন, তবু, অতিচেতনার মতো এক বিরল ও আধ্যাত্মিক ধারণা
থেকে যে অসংখ্য বাঁকা লিরিক জন্ম নিল, এ সত্যিই অবাক করে। সমাজ আর লিরিক চাইছে না,
কারণ সে আজও রবীন্দ্রনাথকেই ফুরোতে পারেনি। ‘নতুন
কবিতা’ বৃহত্তর সামাজিক গুরুত্ব তৈরি করতে পারেনি। এই কবিরা সেটা চেয়েছিলেন বলেও
মনে করি না। এঁরা পাঠকের সংখ্যার চেয়ে নিজেদের কবিতা ও যাপনের প্রতিই উৎসুক।
এর মধ্যে অবিশ্যি বেশ কিছু বানিজ্যিক কাগজ বাঙালি
পাঠকের সনাতন লিরিক প্রবণতাকে ভুল বুঝে বস্তাপচা কিছু পংক্তিবিন্যাসকেই কবিতা
হিসেবে দিনের পর দিন ছেপে চলেছেন। তাঁরা একচক্ষু হরিণের মতো আচরণ করছেন। চড়ুইভাতি
আর ভোজসভাকে ঘুলিয়ে ফেলেছেন। কিছু লব্ধপ্রতিষ্ঠ কবির তুলনায় বরং বাংলা গানের
ব্যান্ডগুলো ভাল কাজ করছে।
কাক আর কবিকে যখন আলাদা করা যাচ্ছে না, নিজেকে
বিশ্রী লাগছে সামাজিকভাবে, সেই পরিস্থিতিতে আমি গোষ্ঠীর বাইরে, তত্ত্ববিভ্রমের
বাইরে পুনরাধুনিকের কথা ভাবি, এবং তার কথা বলার সাহস সঞ্চয় করতে থাকি। সেটার জন্য
সবার আগে প্রয়োজন ছিল নিজের কবিতার সঙ্গে একটা হেস্তনেস্ত করা। গদ্য লিখে
পুনরাধুনিককে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে, কিন্তু কাজটা তো কবিতাতেই করার কথা। কবিতার
গুরুগিরি করার কোনো শখ ছিল না। কবিতার গুরুদের দেখে আজকাল খুব করুণাই হয়। নিজের
কবিতা নিয়েই ভাবছিলাম।
ভাবছিলাম, পুনরাধুনিক কবিতাকে সবার আগে উপনিবেশের
স্মৃতি থেকে সম্পূর্ণ বেরিয়ে আসতে হবে, কিন্তু সেটা কী ভাবে? উত্তর খুব
স্বতঃস্ফূর্তভাবে বেরিয়ে এল, সেটা করতে হবে সবার আগে ভাষার নিরিখে। আমরা আদতে যে
ভাষাটায় কথা বলতে এবং পড়তে-লিখতে অভ্যস্ত, সেটা বাংলিশ। এই যে আমি এই গদ্যটি
লিখছি, সেটাও বাংলিশেই লিখছি। এই ভাষা তার লিখিত রূপে বাংলা হিসেবেই পরিগণিত হয়,
তার বর্ণমালা বাংলা। কিন্তু, সে শরীরে বাংলা হলেও তার আত্মা ইংলিশ। তার ছেদ এবং
যতিচিহ্ন ইংলিশের দান। তার
সিনট্যাক্সে ইংলিশের সঙ্গে
তফাৎ আছে, কিন্তু অনায়াসে সেটা মুছে ফেলে ইংলিশে অনুবাদ করে নেওয়া যায়।
আমি তীব্রভাবে মনে করি, সম্ভব হলে ক্ষমা করবেন,
যে বাংলা কবিতাকে ইংলিশে অনুবাদ করা যায়, তা আসলে বাংলা কবিতাই নয়, হয়তো
আন্তর্জাতিক কবিতা, কিন্তু বাংলা কবিতা নয়। সে প্রথম থেকে শেষ অবধি একটি মাত্র
শারীরিক ‘মানে’-কে সঙ্গে নিয়ে চলতে চায়, ধ্বনিকে নয়, অর্থসম্পদকে নয়। অভিধান তাকে
ছাড়ে না। আমাদের সমকালীন অভিধান ব্রিটিশ উপনিবেশের ও শিক্ষাব্যবস্থার দান। একজন
হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তার বঙ্গীয়করণ করেছেন, এবং অসম্ভব ক্ষমতায় তাকে
‘মানে’-সর্বস্ব হতে দেননি। শব্দকোষ আর অভিধান এক নয়, এক হতেই পারে না। পুনরাধুনিক
কবিতায় একটি শব্দের ধ্বনিই তার অর্থ। যদি ‘ভাত’ বলা হয়, তাহলেই ভাত হয়ে ওঠে, সেটা
অভ্যাস নয়, সেটা ধ্বনিগুণ। গরিলার নাম কখনই হরিণ হতে পারত না, ময়ূরের নাম কখনই
হাতি হতে পারত না, বা মানুষের নাম শয়তান। একটা
শব্দ স্বয়ং একটা জগত। সে কাজ এবং নাম। তার বাইরে তার উদ্ভাস দেখা যেতে পারে,
কিন্তু ‘মানে’-র সীমায় তাকে পাওয়া যাবে না। যেমন ভরি পিছু টাকায় সোনা অধরাই থাকে,
তাকে কেনা যায়, তাকে পাওয়া যায় না।
কবিতায় ছেদ-যতি নিয়ে প্রথম থেকেই ভাবছিলাম। আমি
এদের কবিতার শত্রু মনে করি। তার একমাত্র কারণ এরা বাংলা ভাষায় বহিরাগত। বাংলা ভাষায় বহু কিছুই বহিরাগত, অসংখ্য শব্দ বহিরাগত, সকল ভাষাতেই তাই,
কিন্তু ছেদ-যতি যেটা করে, বাংলা কবিতায় ইংরেজির যুক্তি দাবি করে। ওগুলো বিশ্রামের
জন্য যতটা না ব্যবহৃত হয়, তার চেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় একমাত্রিক ‘মানে’-কে মদত দিতে। আমাদের পয়ারে যে এক দাঁড়ি-দু
দাঁড়ি প্রযুক্ত হত, সেগুলো কিন্তু ফুলস্টপ ছিল না। তারা পাঠককে শুধু রয়েসয়ে পড়ার
আরাম দিত। চৌকাঠের আল্পনার সঙ্গে তার তুলনা চলে। মাইকেল মধুসূদন পরবর্তী বাংলা
কবিতায় আমরা যে পূর্ণচ্ছেদ ব্যবহার করি সে আসলে ফুলস্টপ। সে একটা
উচ্চারণের একেবারেই সমাপ্তি দাবি করে। আজ থেকে দেড়শ বছর পিছিয়ে গেলেই তার দেখা আর
মিলবে না। কমা, সেমিকোলন, কোলন, ড্যাশ, হাইফেন... কোনোটাই আমরা দেখতে পাব না, যদি
এমনকি ঊনবিংশ শতকের প্রথম ভাগের বাংলা কবিতায় যাই। যে কবিরা এগুলো বাংলা কবিতায়
নিয়ে এলেন, তাঁরাও ছিলেন শরীরে বাঙালি, আত্মায় ব্রিটিশ, এবং সেটাই জারি থাকল।
এমনকি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিও আমরা নালিশ
রাখতে পারি এখানে। রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থের কবিতাও আদতে আন্তর্জাতিক, এবং
বাংলিশ ভাষায় লিখিত। ভানু সিংহ যে কাজ শুরু করেছিলেন
খেলাচ্ছলে, পরিণত রবিবাবু তাকে আমল দেননি। কিন্তু তাঁর ‘গীতবিতান’? না, তাঁর গান
বাংলিশ নয়। তাঁর গানই তাঁর আসল কবিতা, এবং সেটা অনেকেই অকাতরে মানবেন। আসলে
একটা বিদেশি শব্দ যদি কবিতায় ব্যবহৃত হয়, তা একটা ভাষাকে উপনিবেশে নিয়ে যায় না,
একমাত্র অন্য ভাষা থেকে সরল যুক্তিকাঠামো ধার করলেই সেটা ঘটে। কবিতার
ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ইংরেজের ভাষার যুক্তি আত্মসাৎ করেছিলেন, শিক্ষিত বাঙালির
সঙ্গে নিজের দূরত্ব ঘোচাতে চেয়েছিলেন, এটা অনস্বীকার্য।
আমি কবিতায় ছেদ-যতি নিয়ে প্রথম থেকেই সমস্যায়
ছিলাম। একেবারে গোড়ার দিকে শুধু কমা ব্যবহার করতাম। ‘যার নাম অপরাজিতা, সেও কিন্তু
নামকরণে হেরে যায়’ বইটিতে লিডর চিহ্ন ব্যবহার করেছিলাম। কোনো ছেদ-যতি ছাড়াও
কিছুদিন লিখলাম। তারপর মনে হল, এতে আমি এই ব্যাপারটাকে হয় স্বীকার করতে পারি, বা
এড়িয়ে থাকতে পারি, কিন্তু লড়াইটা হচ্ছে না।
পুনরাধুনিক প্রকল্প যখন শুরু করলাম, বাংলা ভাষার
যুক্তিকাঠামো সামনে এসে দাঁড়াল। প্রথমেই ইংরজি ভাষার অবদান ফুলস্টপটিকে নিয়ে একটা
সিদ্ধান্তে এলাম। কবিতা শুরুই করলাম দাঁড়ি বসিয়ে। কবিতার প্রথম লাইন হল একটি
দাঁড়ি। কবিতার শেষ লাইনও হল একটি দাঁড়ি। এর ফলে আমার মনে পূর্ণচ্ছেদের প্রচলিত
ধারণা ও তার ঔপনিবেশিক খোয়ারি ভেঙে গেল। সে শেষের নয়, বরং অতিক্রমণের দূত হল।
পেরিয়ে যাওয়ার টিকিট, বিনা কড়িতে। ঠিক যেমন পয়ারের একদাঁড়ি-দু দাঁড়ি। একটা আল্পনার
মতো তাকে আপনি প্রসন্নতায় ডিঙিয়ে যেতে পারবেন। দুটো স্তবকের মধ্যবর্তী স্পেসেও
তাকে বসিয়ে দিলাম, কারণ সেখানেও একটু আল্পনার দাবি শুনতে পেলাম। এসে পড়ল এক
বহমানতা। একটা কবিতার শেষের দাঁড়ি কথা বলল তার পরের কবিতার প্রথমের দাঁড়ির সঙ্গে।
একটাই কবিতা লিখে চললাম, একাধিক শরীরে।
ব্যাকরণের বিধি (वाक्यं स्याद्
योग्यताकाङ्क्षासत्तियुक्तः पदोचेचय़ः) কবিতায় মানলে চলবে না, ব্যাকরণের
কাজ সহজ করা নয়, সরল করে দেওয়া। কবিতায় সরলতা (সহজতা নয়) দুর্বলতা ও নির্বুদ্ধিতার
আরেক নাম। যে কোনো ভাষায় ব্যাকরণ বাক্যের পিছনে হাঁটবে, চিরকাল হেঁটেছে, পন্ডিতরা
যাই বলুন। পন্ডিতদের বেঁধে দেওয়া অর্থসমাপ্তিকে স্বীকার করব কেন? বাক্যের শেষে কোনো পূর্ণচ্ছেদের প্রশ্নই নেই। আমার
কবিতায় একটা দাঁড়ি যে আলাদা দাঁড়ি হয়ে থাকছে, সে আসলে ওই প্রথম দাঁড়ির বন্ধু। কারন
বাক্য আর যাই হোক, সে শেষ হয় না, ফুরোয় না। যে কোনো উচ্চারণ একটি বাক্য। অবিশ্যি আমার এই ধারণা ব্যাকরণ এবং
দর্শনের ভেদটা মুছতে চায়। অর্থের সমাপ্তি ব্যাপারটা আসলে যে শেষ হয়ে হইল না শেষ,
এবং পূর্ণচ্ছেদ হয় না, হতে পারে না, এই বিশ্বাস থেকেই বাক্যের শেষে নয়, বাক্যের শেষ যেহেতু নেই,
স্পন্দন জাগিয়ে রাখতে, প্রয়োজনীয় স্থানেই আমি দাঁড়ি বসিয়ে দিলাম। এক বা একাধিক
শব্দ তখন নিজের কথাটা বলল আরো মুখরতায়। কমা বা লিডরের মতো চিহ্নগুলোও এইভাবেই খুব
কদাচিৎ দেখা দিল। তারা নিঃশব্দ হিসেবেই এল, যতিচিহ্ন নয়, যেন অনুভব করলাম।
ব্যাকরণের দিক থেকে বলতে চাই, প্রায় নাছোড়বান্দার
মতো আমি ব্যবহার করেছি একমাত্র ঘটমান বর্তমানকে। অন্য কোনো ক্রিয়ার কালে যেতে
চাইনি। আমি মনে করি, ক্রিয়ার ওই একটিমাত্র কালই সব তর্কের বাইরে গিয়ে চিরকেলে ও
জ্যান্ত হয়ে ওঠে, সত্যকথনের ভান তাকে করতে হয় না, কবিতাকে সে জ্যান্ত রাখে হরদম, বিশেষ্য আর ক্রিয়ার একীকরণ আভাসিত হয়,
অথচ ভাষাটা সমাজকে অস্বীকার করে না।
অলঙ্কারশাস্ত্রের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা নিয়েই উপমার
ব্যবহার সহসা করতে চাইনি। উপমা আর কোনো মাত্রা বহন করে না কবিতায়, আমার মতে, সে
ছিবড়ে হয়ে গেছে। ‘ফুলের মতো’ বললেই একটা শুকনো সীমাবদ্ধতা এসে পড়ে, তার চেয়ে
‘ঢিলের মতো নয়’ বললে একমাত্র ঢিল বাদ দিয়ে বাকি সব সম্ভাবনা জেগে থাকে, এবং ঢিলও
অনুল্লেখিত থাকে না। আমি মনে করি, অর্থজাত হোক বা ধ্বনিজাত, প্রতিটি অলংকার আমাদের
দৈনন্দিন কথাবার্তা থেকেই সোজা বা একটু বেঁকে কবিতায় হাজির হয়। এরা জীবনবহির্ভূত
আদৌ নয়। কিন্তু কবির ব্যক্তিগত জীবনদৃষ্টির ছাপ তাদের প্রয়োগে লেগে থাকতে হবে। কবি
নিজের অলঙ্কার বানিয়ে নিতেও পারেন, তাই না?
এবার প্রশ্ন এই যে, ইংরেজি শব্দ বাংলা কবিতায় কি ব্যবহার
করব না? আমার মনে হয় শব্দব্যবহারে এরকম মানসিকতা উপনিবেশকে বা উত্তর-উপনিবেশকে দূর
করার বদলে মৌলবাদের জন্ম দেয়। শব্দ আমদানির ব্যাপারটা যতিচিহ্নের সঙ্গে মেলে না। আরেক ভাষার যুক্তিকে নিজের ভাষায়
আমদানি করার অর্থ অবশ্যই নিজের জিভকে অন্যের জিভে অনুবাদ করার বোকামি, এবং
সাংস্কৃতিক আত্মহনন। যুক্তি আসলে ভেদের সৃষ্টি করে। কিন্তু অন্য ভাষার শব্দ যতই
নিজের ভাষায় নিয়ে আসা যায়, ততই নিজের ভাষা আরো বেঁচে ওঠে, আরো বিস্তৃত হয়, লম্বা
হয়। ইংরেজি একটা অত্যন্ত সমৃদ্ধ ভাষা, সে নিজেও বহু দেশ থেকে নিজের শব্দভান্ডার
গড়েছে, বাংলার সঙ্গে তার রক্তের সম্পর্ক বহু শব্দের সাদৃশ্যেই ধরা পড়ে। তার কিছু শব্দ নিজেদের কবিতায় গ্রহণ করা যেতেই পারে, তবে ‘মানে’-র জন্য নয়, ধ্বনিগুণের স্বার্থে।
এখানে উপনিবেশের ছায়া নেই, হীনমন্যতার কারণ নেই।
মনে রাখা ভাল, ‘বাবু’ ‘বাজার’ ‘বারান্দা’
‘মহারাজা’ বা ‘লাঠিচার্জ’... কোনো ইংরেজ এগুলোকে আজ বাদ দিয়ে চলতে পারবেন না। একটা
ইংরেজি শব্দ এবং একটা তামিল শব্দের মধ্যে কোনো ফারাক এক পুনরাধুনিক কবি করবেন না।
শব্দ এক ধ্বনিস্ফটিক, তাতে ডুব দিয়ে কবি কী দেখলেন, পাঠক কী পেলেন, সেটাই বিচার্য।
শব্দের জন্ম হয়, মৃত্যু হয়, পুনর্জন্ম হয়, কিন্তু জাত বা দেশের সীমানা হয় না।
পৃথিবীর যে কোনো দুটো ভাষাই আত্মীয়, সহোদর, কিন্তু প্রতাপের অবকাশ যেন দেখা না
দেয়।
এখন প্রশ্ন, এই আমার যে লেখা, এটাও কি বাংলা
কবিতা। আমি তো সেটাই দাবি করব। তবে বলব,
নতুন বাংলা কবিতা। উপনিবেশের ধার না ধেরে। আমি ছাড়া যদি কোনো কবি পুনরাধুনিকের পথে
পা রাখেন, তিনিও কি এটাই করবেন? করবেন না। করলে আমার নকল হবেন। অবশ্যই
তাঁকে পথ খুঁজতে হবে যাতে তাঁর কবিতা বাংলিশ না হয়ে ওঠে। ছেদ-যতি থেকে না পালিয়েই
সেটা করতে হবে। নিজের ক্রিয়ার কাল তাঁকে ঠিক করতে হবে। সেটা তাঁর পথ। আমার নয়।
আধুনিক কবিতার বিরুদ্ধে এক মস্ত অভিযোগ হল লেখকের
প্রভুত্ব পাঠকের উপরে। পোস্টমডার্ন কবি পাঠককে নাকি ভরপুর সাঁতার দেন, আর আধুনিক
কবিতা নাকি এক বদ্ধ ও এলিট জলাশয়, সে সাঁতারের জন্য নয়। এ এক অর্থহীন অভিযোগ। শেষ
অবধি স্বাধীনতা দেওয়ার একটা সীমা এসেই পড়ে, যেহেতু পোস্টমডার্ন কবিতা সাদা পাতায়
পর্যবসিত হয় না। আধুনিক কবিতার উদাহরণ কোনগুলো? শেকসপীয়ারের সনেট?
ওয়াল্ট হুইটম্যানের কবিতা? কীটসের ওডগুলো? ইয়েটসের যে কোনো কবিতা? এদের মধ্যে
কোনটায় আপনি একরৈখিকতা, বদ্ধ আঙ্গিক, আর চরম সমাপ্তি খুঁজে পান, এবং আমাদের যে
কোনো ঘোষিত পোস্টমডার্নের কলমে সেগুলো ধুয়েমুছে যায়? পৃথিবীর মহত্তম আধুনিক কবিদের
কবিতা যদি যে কোনো দেশে কালে নতুন করে নির্মিত হওয়ার যোগ্যতা না রাখত, আজ আমরা
শেকসপীয়ার, চসার, মিলটন, বা হুইটম্যান বা কীটস বা ইয়েটস বা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কথা
বলার সাধ বা স্বাদ টের পেতাম কি? পাঠককে স্বাধীনতা দেওয়া একরকম স্পর্ধা ছাড়া কিছু
নয়, কারণ প্রকৃত পাঠক নিজের মুক্তি যেকোনো পাঠবস্তুতেই খুঁজে নেবেন, তবে একটা স্তর
অবধি, নিজের শক্তি অনুসারে। পাঠকের মুক্তি পাঠকের নিজের ক্ষমতা ও দৃষ্টিকোণের উপরে
নির্ভর করে, কবির উপরে নয়, ফার্দিনান্দ ডি সস্যুর, চমস্কি, মিশেল ফুকো বা জাক
দেরিদার উপরেও নয়।
যে কোনো কবি তাঁর কবিতায় নিজের কথাই বলেন।
প্রশ্নটা হল সর্বজনীনতা। সভয়েই বলছি, কোনো পাঠ্যবস্তু সর্বজনীন হতে পারে না। সে
যেতে পারে বিচিত্র পথে, কিন্তু হতে পারে না সর্বত্রগামী। কেন্দ্রকে যে কোনো
পাঠ্যবস্তুই অস্বীকার করে, সেটার জন্য লেখক বা কবিকে আলাদা কোনো প্রয়াস করতে হয়
না। যে কোনো লিখিত বস্তুই লেখককে পিছনে ফেলে পৃথিবীতে পা রাখে। সে তার নিজের
এককত্বকে বারবার প্রশ্ন করে নিজেই। বাঁধা পথে চলতে পারে না, সেটা লেখক চাইলেও তাঁর
লেখা চলবে না। অগ্রগতি বলে কিছু নেই, সামনে এগিয়ে যাওয়া একটা
মিথমাত্র, কাজেই সে ছড়িয়েই পড়ে। নিজেকে নিজেই ব্যহত করে, আবার সচলও করে। এক যুগে
হারিয়ে গিয়ে আরেক যুগে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কবির কন্ঠে তাঁর ভিতরের অনেক কবি কথা
বলেন, স্মৃতি নিয়ে অভিজ্ঞতা নিয়ে আবেগের বিভিন্ন স্তর থেকে। কন্ঠস্বরের
বহুত্ব তো থাকবেই, এবং অপরিসীম। যতই কবি তাঁর লেখার আয়োজন করেন, সে তাঁর আঙুলের
ফাঁক গলে পালায়। মানবের কথা বলতে যদি চায় তাঁর কলম, ঠিক আছে, কিন্তু মানবকল্যাণের
দাবি তার টেকে না। রক্তদান শিবির যিনি করেন, আর কবিতা যিনি লেখেন, তাঁরা এক লোক
নন। কবি কোনো সমাজকর্মী নন। রাখিবন্ধনের রবীন্দ্রনাথ আর কবি রবীন্দ্রনাথ এক নন।
কবি রবীন্দ্রনাথ সবার রবীন্দ্রনাথ হতে পারেননি।
কবি চান প্রতীক, আর সে কবির কাছে তাঁর অবলোকন ও
যাপনের বিবিধ চিহ্ন ছিনিয়ে নেয়, দাবি করে এক অনন্য উচ্চারণবিধি। পৃথিবীর যে কোনো
মহৎ কবিতায় এই লক্ষণগুলো বিদ্যমান। সেগুলোয় পোস্টমডার্নের দাবি চাপিয়ে দেওয়া
তত্ত্ববিস্তারমাত্র। এবং, এই গুণগুলোয় আধুনিকেরও কোনো দাবি নেই। এগুলো শুধুমাত্র
উৎকৃষ্ট কবিতার গুণ, যে কোনো যুগে ও দেশে। আধুনিক বা পোস্টমডার্ন বা পুনরাধুনিক,
কোনো কবিতাই এগুলোকে আলাদা করে দাবি করতে পারে না, কারণ কবিতা শেষ অবধি নিজের এই
সাধারণ গুণগুলো ছাড়ে না।
কিন্তু পাঠকের মনে একটা বোধ কাজ করেই, পাঠবস্তুর
কোনো না কোনো স্তরে তা তাঁকে অলস ও অক্ষম করে। কবির সক্রিয়তা (প্রভুত্ব নয়) এবং
পাঠকের স্বীয় নিষ্ক্রিয়তার (দাসত্ব নয়) একটা অভ্যস্ত বাতাবরণ পাঠককে ঘিরে রাখে।
একজন পুনরাধুনিক কবির খেলা হল সেই পাঠকের অজান্তেই তাঁর নিষ্ক্রিয়তায় আঘাত করা।
হ্যাঁ, খেলা, যা আসলে লেখার আনন্দ বাঁচিয়ে রাখে। এই খেলার মেজাজেই আমি একদিন শুরু
করলাম একেকটা শব্দ বা একাধিক শব্দকে বা কথাকে কেটে দেওয়া। কাটা অবস্থাতেই শব্দ ও
কথাগুলো থাকল কবিতায়। কখনও তার বদলে আরেক শব্দ বা কথা আনলাম, কখনও আনলাম না। আশা
করলাম, যে কোনো পাঠক ওই কাটা শব্দ বা কথাকে জুড়ে নেবেন, অথবা আমার কাটাকেই মেনে
নেবেন। নিজের অজান্তেই তাঁর আলস্য যাবে কেটে। আমাকে আর কোনো পাঠকেরই পাঠ-পরিচালনার
অলীক ভারটা বইতে হবে না। আমার দিব্য অবস্থান আমি নিজেই খারিজ করলাম, এবং আমার মনে
হয় না সেটা পোস্টমডার্ন কবিসুলভ আচরণ হল। এই খারিজের অধিকার আমাকে কে দিল? আমিই তো দিলাম। কেন দিলাম? এই প্রশ্ন যদি করা
হয়, শেষ অবধি সাদা পাতা ছাড়া কেউ উত্তর দিতে পারবে না। একজন কবির সবচেয়ে বড়ো শত্রু
হল এই সাদা পাতা, সে সর্বদাই অনধিকারচর্চার অভিযোগ তৈরি রাখে।
এবার আমাদের ভাবা দরকার, কীসের জোরে কবিতা
কালোত্তীর্ণ হয়? কাল তো সময় নয়। ঘড়ির ও ক্যালেন্ডারের সময় এক জাগতিক ধারণা। কাল হল
মহাজাগতিক। সে দেশের সঙ্গে একীকৃত। দেশ ছাড়া কাল
নেই। কাল-এর কোনো ইংরেজি হয় না, অভিধান যাই
বলুক। সময়ের ইংরেজি হল টাইম, সে ঘড়িতে থাকে, কাল থাকে অনাদি অনন্ত এক চক্রে, এবং, যা কালকে অতিক্রম করবে, তা দেশকেও
অতিক্রম করবেই। চর্যাপদের কালে যেমন আমরা নেই, চর্যাপদের দেশেও আমরা নেই। অ্যাংলো-স্যাক্সন
কবিদের কালে আমরা নেই, তাঁদের দেশটাও কিন্তু ওয়র্লড কাপের ইংল্যান্ড নয়। এটা মাথায়
রাখতে হবে। আজও আমরা ভুসুকুপাদ বা কাহ্নপাদ বা কৃষ্ণদাস কবিরাজ বা ‘বিউলফ’ পড়ে
ঋদ্ধ হই, মুগ্ধ হই, প্রসন্ন হই। ভুসুকুপাদের বাংলা আমাদের বাংলা কিন্তু নয়।
‘বিউলফ’ বা ‘সী ফারার’-এর ইংরেজি ইংল্যান্ডের সমকালীন যুবক-যুবতীরা অনুবাদেই
পড়বেন, মূল ভাষার কিছুই বুঝবেন কিনা সন্দেহ আছে।
তবু, এটা কী করে ঘটছে? মহাকাল এবং মহাদেশের কোন
ষড়যন্ত্র একজন কবিকে অমর করে দেয়?
কালোত্তীর্ণ কবি শব্দসংস্থানের কারিগর নন। তিনি
ব্যাকরণ আর অভিধানের বাইরে। তিনি বাক্যের লোক। তাঁর পথ যেমন বাক্য, তাঁর গন্তব্যও
হল বাক্য। আমাদের সমকালীন বাংলা কবিতা থেকে এই পথ ও গন্তব্য হারিয়ে যাচ্ছে। কিছু
কবি আছেন, তাঁরা নিজেদের কবিতায় সামাজিক শব্দসংস্থানের সঙ্গে একটা ব্যক্তিগত
হেস্তনেস্ত করে ফেলতে চেয়েছেন, নিজেদের ক্ষমতার গুণে, মেধা-মনীষা-আবেগের সন্তুলনে,
শক্তির প্রাবল্যে অনেকদূর সফল হয়েছেন। হ্যাঁ, এঁরা সমসাময়িক (সমকালীন কিনা বলা
যাচ্ছে না) প্রবল কবি। যেমন মণীন্দ্র
গুপ্ত, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, আল মাহমুদ, সুনীল
গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, আলোক সরকার, উৎপল কুমার বসু, দেবারতি মিত্র,
মলয় রায়চৌধুরী, ফাল্গুনী রায়, পুষ্কর দাশগুপ্ত, ভাস্কর চক্রবর্তী, অমিতাভ মৈত্র,
জয় গোস্বামী... এঁরা সংক্রামক। এঁদের
কবিতার আক্রমণাত্মক প্রভাব তরুণতরদের উপরে পড়েছে। এঁদের কারো কারো মতো লেখার
চেষ্টা অনেককে করতে দেখি, হতে পারে বিবিধ কারনে।
মজার কথা হল, স্বদেশ সেনের কবিতার নকল হতে দেখি
না, কেউ কেউ চেষ্টা করলেই ধরা পড়ে যান। রমেন্দ্র কুমার আচার্য চৌধুরীর নকল সম্ভবত হতে পারে না। শেষ পর্বের বিনয় মজুমদারের
কবিতার নকল কেউই করতে চাইবেন বলে মনে হয় না। তাহলে এঁরা কি প্রবল কবি নন? না।
প্রবল কবি নন। এঁরা একেকটা পৃথিবীর নাম। পৃথিবী নামক
গ্রহটা আসলে কী? পৃথিবী হল কমলালেবুর আকার নেওয়া এক ভাষা। রাখা হয়েছে ভাষা। ভাষার
স্ফটিক। এটা জানতে পারি উপনিষদ এবং বিবেকানন্দ রচনাবলী অধ্যয়ন করতে গিয়ে। এই
পৃথিবীকে আমি সেমানটিক্স হিসেবে কিছুটা খুঁজে পেয়েছি ভাষাতত্ত্বের বইগুলোয়।
জনপ্রিয় কবি মধুর ও লালিত্যময় বা উস্কানিমূলক
শব্দের কারবার করেন, প্রবল কবি সিনট্যাক্সের চর্চা করেন অর্থাৎ শব্দসংস্থানের, আর
কালোত্তীর্ণ কবি থাকেন সেমানটিক্সে। কালোত্তীর্ণ কবি তাঁর কবিতায় হয়ে ওঠেন ‘আমিই
সে’। মোহ অতিক্রম করে যান, কিন্তু জড়িয়ে নেন মায়াকে, এই পৃথিবীর মধুমাখা ধুলোকে
তিনি অসার ভাবেন না। ভাষার এক অভূতপূর্ব ও অশ্রুতপূর্ব কোড তাঁর হাতের মুঠোয়
লুকোচুরি খেলছে, তাকে ধরার অছিলায় আসলে তিনি নিজেকেই ডি-কোড করছেন। কারণ,
অবশ্যই, একজন কবি অদ্বৈতবাদী নন, অদ্বৈতবাদীর জন্য কোনো কবিতা নেই। দ্বৈতবাদী তো
যাবেন পুজোর ঘরে, কীর্তনের আসরে গড়াগড়ি খাবেন, চোখের জলে ভাসিয়ে দেবেন ঠাকুরের পা
বা আখড়া। কৃষ্ণদাস কবিরাজ, কবীর, তুলসীদাস, রামপ্রসাদ,
রামকৃষ্ণ, লালন সাঁইদের একটা আলাদা জগত আছে। ওঁরা আধুনিক কিনা এই প্রশ্ন ওঠে না।
এঁরা কবি কিনা সেই প্রশ্নটাও অর্থহীন। নুনের পুতুল নুনের সাগরে গেলে যেটা হয়,
প্রশ্নটাই অর্থহীন হয়ে যায়। একজন
কালোত্তীর্ণ কবি, আমার মতে, জেনে বা না জেনেই একজন দ্বৈতাদ্বৈতবাদী মানুষ। তিনি নাস্তিক নন। একজন প্রকৃত কবি নাস্তিক হতেই পারেন না। যদি প্রচলিত
ঈশ্বরে তাঁর না চলে, নিজের ঈশ্বর তিনি বানিয়েই নেন, ভাষাঈশ্বর, তাঁকে ভালবাসেন,
তাঁর সঙ্গে কলহ করেন। নিজের একটা
পৃথিবী তিনি ‘তাঁর’ জন্যই গড়েন, পিছলে যান, ফিরে আসেন,
শেষ অবধি মরার পরেও রেখে যেতে পারেন।
![]() |
বিনয় মজুমদার (চিত্রগ্রাহকের নাম জানতে পারিনি) |
হ্যাঁ, একজন পুনরাধুনিক কবি এক হয়ে উঠতে চাওয়া
ভাষাপৃথিবী। কথার জন্ম তিনি সম্পূর্ণ করতে চান। অভিধান
তো কোন ছার, সিনট্যাক্স তাঁর নাগাল পাবে না। শব্দের সঙ্গে শব্দের বিয়ে দেওয়ার
ম্যারেজ রেজিস্ট্রার তিনি নন। তিনি শব্দের ত্রাতা, ও তার আগে শব্দের সর্বনাশকারী।
তিনি স্বয়ং... হয়ে ওঠা ভাষাচেতনা। সাম্প্রতিক অতীতে রমেন্দ্র কুমার আচার্য চৌধুরী (খাঁটি বাঙালি কবি,
সংস্কৃতির বিগ্রহ হতে পারে তাঁর যে কোন অক্ষর), স্বদেশ সেন (এক অসীম মানবচেতনা), এবং অন্তিম
পর্বের বিনয় মজুমদার (মূর্তিমান ভাষাচেতনা) ছাড়া এই কথা আর কারো ক্ষেত্রে আমি বলতে
পারি না, পাঠক মার্জনা করবেন। এ আমাদের খুবই সৌভাগ্য, যে প্রায় একইসঙ্গে এঁরা
আমাদের মধ্যে বেঁচেছিলেন, একই পাগলাটে হাওয়ায় আমরা শ্বাস নিয়েছিলাম, ওঁরা কাজ
করেছিলেন। অবিশ্যি, আমরা তাঁদের দিকে পূর্ণ চোখে তাকাতে পেরেছি কিনা, আমি বলতে
পারি না, বলতে চাই না।
হ্যাঁ, পুনরাধুনিক কবি শব্দের সর্বনাশ করে তার ত্রাণ
দেবেন। সর্বনাশ শুনলেই কি ঘরপোড়া গরু মনে পড়ে, পাঠক? এই ব্যাপারটায় একটু বলি।
এমনকি একজন প্রবল কবিও শব্দকে সর্বদা অভিধান মেনে ব্যবহার করেন না, ব্যাকরণের
প্রায়ই ধার ধারেন না। শব্দকে তিনি বদলে নেন, বাঁকিয়ে নেন। তাহলে কালোত্তীর্ণ কবির
ক্ষেত্রে তো কথাই নেই। একজন পুনরাধুনিক কবির একমাত্র লক্ষ্য কালোত্তীর্ণ হওয়া, এবং
সেই সুবাদেই সমকালকে জয় করা। এই জয়ে
কিন্তু কোনো ট্রোফি নেই, ভিকট্রি ল্যাপ নেই, চিয়ার লিডার্স নেই। আসলে বনে উধাও
সোনার হরিণটির কমে তাঁর তৃপ্তি নেই। শব্দের সামূহিক স্মৃতি, শব্দের সমসময়, শব্দের
আবেগ জাগানোর প্রবণতা... এই সবকিছুর সন্তুলন তাঁর মুখ চেয়ে আছে। ফলে, সেই
উচ্চারণবিধি তাঁকে অর্জন করতেই হবে, যা একটা পৃথিবী, এবং সেখানে তাঁর উপরে কোনো
শাসন নেই। পাঠক সেই পৃথিবীতে এসে পড়ে বাস করতে পারেন, চলেও
যেতে পারেন ছেড়ে, কিন্তু পৃথিবীটা যে নেই, এ বলার কোনো সুযোগ কোনো পাঠকেরই হবে না।
কবির বাসভূমি পাঠকের বাসভূমি হবে, এমন আশ্বাস নিয়ে পুনরাধুনিক কবি কাজ করবেন না।
স্বদেশ সেন নামক গ্রহটিতে, বা রমেন্দ্র কুমার আচার্য চৌধুরী নামক দ্বীপটিতে, বিনয়
মজুমদার (অন্তিম পর্বের) নামক বনভূমিটিতে অঙ্গুলিমেয় সভ্য লোক আজ বাস করেন। এই
তিনটি নামই যথেষ্ট উদাহরণ। অবিশ্যি এই তিনজন পুনরাধুনিক নন। এঁরা আমার নিজস্ব
পুনরাধুনিকের কয়েকজন দিশারী। এটা ব্যক্তিগতভাবেই আমি মনে করি। অন্য পুনরাধুনিক
তাঁর দিশা অন্য কোনো কবির মধ্যে খুঁজে নিতে পারবেন। কিন্তু নকল করবেন না।
পুনরাধুনিকে ক্লোন হওয়ার অবকাশ নেই। কাউকে ক্লোন বানানোরও না।
এবার আসি আরেক বিতর্কে। পুনরাধুনিক কবিতা কি
বিষয়হীন? না। কারন এ যাবত লিখিত ও প্রকাশিত কোনো কবিতাই বিষয়হীন নয়। বিষয়হীনতা
একটা সস্তা মিথমাত্র। একটা পাঠ্যবস্তু, সে কবিতা হোক বা বাজারের ফর্দ, একটাই বিষয়ে
হয় না, হতে পারে না। সে ছড়িয়ে যাবেই, বিদীর্ণ হবেই। ‘মা, ভাত দাও’... শুধু এই একটি
বাক্যই হাজার-হাজার হয়ে উঠতে পারে হাজার-হাজার বিস্তারে। মায়ের মনেও জাগাতে পারে
হাজার অনুভূতি। ‘সোনার তরী’ কবিতাটির বিষয় কী... কেউ বলতে পারেন? ‘আফ্রিকা’ কবিতা
কি রবীন্দ্রনাথ শুধু আফ্রিকাকে নিয়ে লিখেছিলেন? কেউ বলবেন সেটা? কিছু অধ্যাপক হয়তো
সেই স্পর্ধা দেখাতে পারেন, রসের দরবারে তাঁদের প্রবেশাধিকার নেই।
তাহলে আলাদা করে বিষয়হীনতা নিয়ে আলোচনার অবকাশ
কোথায়?
আমরা ধরে নিতে পারি, বিষয়হীনতা নিয়ে কথা বলার
মানেই হয় না, কারন কোনো না কোনো কিছু প্রকাশ করার জ্ঞাত বা অজ্ঞাত উদ্দেশ্য ছাড়া
কেউ কবিতা লেখেন না, কিছুই লেখেন না। সেই উদ্দেশ্যটাই কবিতার বিষয়। সেটা অবিশ্যি
পাঠক খুঁজে না-ও পেতে পারেন। সেক্ষেত্রে পাঠকের পাঠই হবে কবিতাটির বিষয়। পুনরাধুনিক
কবি অবশ্যই কিছু প্রকাশ করবেন তাঁর কবিতায়, নাহলে ছাপতে দেবেন না, তবে সেটা লেখার
শুরুতে তিনি জানবেন না, এবং লেখার শেষে তিনি তা উপলব্ধি করবেন। যদি তাঁর সেই
লেখাটিতে নিজের কোনো আলো জাগে, নিজের কোনো অভূতপূর্ব উদ্ভাস তিনি পান, তবেই তিনি
তা সাধারণের সঙ্গে ভাগ করার দুঃসাহস করুন, ছাপার অনুমতি দিন। কবিতাটা ভাল হয়েছে কি
মন্দ, ভাল লাগছে কি মন্দ, এই প্রশ্ন আজ অবান্তর। আজ যে কেউ ভাল কবিতা লেখা শিখে
নিচ্ছেন ও অনায়াসেই লিখছেন। খারাপ কবিতা কেউ লিখতেই পারবেন না সম্ভবত, কারন খারাপ
কবিতা মোটেই অশিক্ষিত কবিতা নয়। হ্যাঁ, অচিন ওই আলো আর অপূর্ব উদ্ভাসটাই ওই
লেখাটির বিষয়। পাঠক তা পেলেন কিনা, তা পাঠকের স্বভাব ও সেন্সর।
যদি কবিতা ও কামের প্রশ্ন ওঠে, পুরুষের কবিতায় আজ
বনলতা সেন বা নীরার দিন ফুরিয়ে যাওয়াই মঙ্গল। একটি সাবান কেমন তাঁর প্রেমিকার সারা
শরীরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, এইভাবে আজ নারীকে আঁকবেন না একজন পুনরাধুনিক কবি। পৌঁছতে
চাইবেন নারী ও পুরুষের একীকরণে। নারী আর
পুরুষের মধ্যে যা শারীরিক, মানসিক, মনঃস্তাত্ত্বিক ভেদ, তা দ্রুত মুছে যাচ্ছে।
শুধু ক্লিটোরিস আর পেনিস... এই নিরিখে আজ মানুষের আত্মপরিচয় নির্ধারিত হবে কেন?
শরীরের ভিতরে তিনি মৈথুন করেন, নাকি শরীরের বাইরে, এতে ফ্রয়েড সাহেব যতই স্বর্গে-নরকে
নড়েচড়ে বসুন, একজন পুনরাধুনিক কবি তা কবিতা লেখার সময় ভুলেই যাবেন। এই পরিসর হোক
ইউনিসেক্সুয়াল। কবিতায় লিঙ্গচেতনার দিন ফুরিয়ে গেছে। সে ছাত্রটির কথাই বরং ভাবা
যাক যার প্রাইভেট টিউটর রোজ তার পায়ুকে ক্ষতবিক্ষত করছেন, সে গ্লানি আরো গ্লানিতে
ডুবে যাচ্ছে। ধর্ষণ শুধু মেয়েদের উপরেই হয়, এটা এই সমাজে প্রতিষ্টিত তথ্য হতে
পারে, কিন্তু একমাত্র প্রাকৃতিক সত্য নয়। মেয়েরাও আজ পুরুষের শিশ্নের স্তুতি
সেভাবেই করছেন যেভাবে এক পুরুষ এক মেয়ের স্তনের, এবং সেটাও সমর্থনযোগ্য নয়, কারন
মৈথুন এবং মাংসের ভেদ ওখানে থাকছে না।
হ্যাঁ, যদি কামের প্রসঙ্গ আনেন পুনরাধুনিক কবি,
ক্লিনিকাল সততা ও নির্দ্বিধার সঙ্গে আনুন। কোনো মোহের সুযোগ যেন কামপ্রসঙ্গে না
থাকে। আমার একটি কবিতার নাম ‘ঠাপ’, একটি অনলাইন
ম্যাগাজিনে প্রকাশিত। সেই নামকরণ নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়ে গেল। আজও আমরা শব্দকে
অশ্লীল ভাবার স্পর্ধা করি। আজও
আমরা কামকে তত সহজে নিতে পারছি না, যত সহজে ক্রোধ এমনকি লোভ বা মোহকে নিতে পারছি।
এর ফলেই আজও সমাজে নারী-পুরুষের ধারণাটিও স্বাভাবিক হল না। কবিরাও কামকে মোহের
সঙ্গে মিলিয়ে আরো বিপজ্জনক করে তুললেন অপ্রস্তুত পাঠকের সামনে। পদাবলীর কবিরা, বা
খাজুরাহোর ভাস্করদের মধ্য এই দ্বিধা ছিল না, তাঁরা মুখমেহন, পায়ুমেহন, পশুকামকেও
অবলীলায় খোদাই করেছেন। এই দ্বিধা, আমরা জানি, ভিক্টোরিয়ান উপনিবেশের দান।
যদি সমাজচেতনার প্রশ্ন ওঠে, একজন পুনরাধুনিকের
কবিতায় বরং বিশ্বচেতনতার উত্তর ফুটে উঠুক। তাঁর কলমে নারীনির্যাতন ঠিক ততটাই
বেদনার রেখা আঁকবে, যতটা তাঁর উদ্বেগ থাকবে অসংখ্য বন্যপ্রাণীর অবলুপ্তি নিয়ে।
সমাজ থেকে দয়া ও বিনয় যেমন মুছে যাচ্ছে, পৃথিবী থেকে রোজ মুছে যাচ্ছে বায়ুমন্ডলকে
রক্ষা করার অনেক উপায় ও উপাদান। একজন পুনরাধুনিক নিসর্গে মজবেন না, তিনি প্রকৃতির
প্রতি সচেতন হবেন, যে সচেতনতা আমরা বিভূতিভূষন বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যে পাই। পুনরাধুনিক
কবি জানবেন তিনি নিজেই প্রকৃতি। মানুষ নামক প্রকৃতি অমানুষিক প্রকৃতিকে রোজ
মৃত্যুর দিকে নিয়ে যাচ্ছে। একটা গাছ অথবা একটা নীল তিমিকে বাঁচানোর তাগিদ যদি তাঁর
কলম থেকে পাঠককে তিনি দিতে পারেন, তা আসলে হল তাঁরই আত্মরক্ষা। বায়ুমন্ডলের ওজন
স্তরের ক্ষয়, আমাদের নৈতিক মেরুদন্ডের বেঁকে যাওয়ার চেয়ে কম বিপজ্জনক নয়। ট্রাফিক
কনস্টেবলের নেওয়া ঘুষ কিন্তু অতটা নাশক নয়, যতটা গ্লোবাল ওয়ার্মিং, অগণিত বেআইনি
গাড়ির গাঢ় শ্বাসরোধী ধোঁয়া। ভিখিরি বালককে দেখে তিনি ঠিক ততটাই কষ্ট পাবেন, যতটা
পারমাণবিক পরীক্ষার ফলে অসুস্থ একটা প্রাণিকে দেখে। এক কথায়, পুনরাধুনিক কবি
জানবেন ফুল খেলবার দিন যেমন আজ নয়, শখের বিলাপেরও নয়। সবার উপরে মানুষই সত্য নয়,
সবার উপরে প্রকৃতি, মানুষই প্রকৃতি। প্রকৃতির বিরোধিতা করার বোদলেয়ারীয় ভুল
পুনরাধুনিকের মানায় না।
আর রাজনীতি? পাঠক, অ-রাজনৈতিক কোনো মানুষ নন। পুনরাধুনিক
কবি অবিশ্যি রাজনৈতিক ঠিক ততটাই, যতটা তিনি পারবেন সর্বস্তরে রাজনীতির প্রবেশের
বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে, সেই রাজনীতি যা প্রতাপ
এবং বাহুবল ছাড়া কিছু বোঝে না। না, সমাজ
উদ্ধারের আশায় একজন পুনরাধুনিক কবি কোনো রাজনৈতিক দলের অংশ নিজেকে করতেই পারেন না।
তাঁর রাজনীতি ব্যক্তিগত রাজনীতি। তাঁর শ্লোগান ও গান তাঁর নিজের। কবিতা লিখে
সমাজকে বদলানো যায় না। এক বা একাধিক মানুষকে অবশ্যই বদলে ফেলা যায়। এবং, অবশ্যই
একজন কবি খবরের কাগজ নন, নিউজ চ্যানেল নন।
একটা বিরাট প্রশ্নের মুখে আমাদের পড়তেই হয়, আজ
থেকে ৫০ বছর পরে বাংলা কবিতা কী হবে, কেমন হবে? এর উত্তর দেওয়ার দায় কবির নেই।
তিনি হাতগনক নন। কিন্তু একটা কথা স্পষ্ট, কবিতা আজ আর কবিতার জায়গায় নেই। কবিতা
কোনোকালেই কি কবিতার জায়গায় ছিল? কোন মহৎ কবি তাঁর সমসময়ে প্রচলিত কবিতা লিখেছেন?
কেউ না। যে কোনো মহৎ কবিই তাঁর সমসময়ের কবিতা-ফ্যাশনকে ধ্বংস করে দেন। কেউই
ব্যতিক্রম নন। যেটার গায়ে প্রতিকবিতার ট্যাগ লাগানো হয়, অপর কবিতার লেবেল লাগানো
হয়, আদতে সেটাই কবিতা, তাকে নিয়ে হীনমন্যতার কোনো কারন নেই, যদিও সমাজ তাকে মেনে
নিতে সময় নেয়। পুনরাধুনিক কবিতাও সেই কবিতাই, সে মোটেই ভবিষ্যতের কবিতা নয়, কবি
সেই দাবি করার মূঢ়তা দেখাবেন না। তাঁর স্টাইল যে একদিন ফ্যাশনে পর্যবসিত হতে পারে,
এবং একমাত্র তখনই তিনি ক্যাননাইজড হবেন, এ চিরাচরিত ব্যাপার, এতে তাঁর জয় নেই, শ্লাঘাও
নেই। যতদিন তাঁকে অনুকরণ না করা হচ্ছে, ঠিক ততদিনই তিনি নতুন থাকবেন, পুনরাধুনিক কবি
জানেন।
এবার আসা যাক দুর্বোধ্যতার প্রশ্নে। একটাই কথা
বলার, কোনো বাক্যই বোধগম্য নয়। কোনো কবিতাই বোঝা যায় না। আমরা কোথাও না কোথাও যে
কোনো উচ্চারণেরই একটা স্তরে আটকে যাই, একটা কোণে হোঁচট খাই। কবিতাই শুধু নয়, যে
কোনো লিখিত ও উক্ত কিছুর ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য। কবিতার মানে হয় না, এটা আজ বলাই
বাহুল্য। তবু, শৈলীর জটিলতা আর অনিশ্চয়তার একটা প্রসঙ্গ থেকেই যায়। পুনরাধুনিক
কবিকে তাঁর শৈলী নিয়ে একটা সিদ্ধান্ত ও অবস্থানে আসতে হবে, এবং বিবর্তন তারপরেও
জারি রাখতে হবে, এটা বলা বাহুল্য। একটা অবাস্তব ধারণা অনেকেরই আছে, সভ্যতা আর
আধুনিক বুঝি সরল থেকে জটিল, ও স্বাভাবিক থেকে কৃত্রিমের দিকে যায়। সেটা সম্ভব নয়,
কারণ সেটা হলে আগুন আর চাকা আবিষ্কারের উদ্দেশ্য নিয়েই প্রশ্ন উঠে যাবে। চলতে না
পারার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ছিল চাকা। আদিমের বিরুদ্ধে সভ্যতার দ্রোহ ছিল আগুন। আর
মানুষ কথা বলেছিল কারন সে মহাপৃথিবীর নির্মম স্তব্ধতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে
চেয়েছিল শব্দ আর নিঃশব্দের দুই হাত মেলে। সে পরিস্থিতিটা সহজ করতেই চেয়েছিল কথা
বলে। সে আসলে কথা না বলতে পারার অদ্ভুত জটিলতাকেই শেষ করে দিতে চেয়েছিল। পারেনি।
তাই আমরা আজও কাজ করতে পারছি কথা নিয়ে। কথা বলতে চাওয়ার সেই ডু অর ডাই প্রক্রিয়াটি
আজও জারি আছে। কথার জন্মপ্রক্রিয়া বলা যায় সেটাকে, কারন কথা তার সম্পূর্ণ জন্ম আজও
লাভ করেনি। মানুষের কি সেই সাধ্য হবে? তার জরায়ু কি অত জায়গা পাবে? এসব প্রশ্ন
উপনিষদে যায়। কিন্তু একজন পুনরাধুনিক কবি কথা বলতে চান। তিনি শ্রোতা চান। যেটা
বলেন, তার চেয়ে সরল কোনো পথ তাঁরা জানা নেই বলেই ওভাবে বলেন। এই ‘ওভাবে বলাটা’-ই
কবিতা।
শৈলীটাই কবিতা। একজন কবি তাঁর শৈলী
ছাড়া কিছুই নন। সেই শৈলী কেউ তাঁকে দেবে না,
তিনিও কারো কাছে হাত পেতে তা চাইবেন না। একজন পুনরাধুনিক কবিকে তাঁর নিজের শৈলীতে
পৌঁছতেই হবে। কবিতার উপরে নাম লেখার প্রয়োজন যেন তাঁর না হয়। সকলেই কবি নন,
কবিভেকধারী অগণিত থাকতে পারেন, কিন্তু যাঁর নিজস্ব শৈলী আছে একমাত্র তিনি কবি।
কবিতার উপরে নাম লিখে কেউ কবি হয় না, আবার বলছি, ক্ষমা করবেন, কবিতার উপরে নাম
লেখার প্রয়োজন ফুরোলে কবি হয়। তাঁর শৈলী হবে সবচেয়ে অনাড়ম্বর, প্রয়োজনীয়, ও সহজ।
যে কোনো আড়ম্বরই ক্লেদাক্ত হয়, ওই ক্লেদটুকুতেই জটিলতা থেকে যায়, এবং পাঠক
প্রতারিত ও বিরক্ত বোধ করেন, তা সে বিদ্যায়তনিক ছন্দবদ্ধতার আড়ম্বর হোক, বা
বক্তব্যের। পুনরাধুনিক কবিতায় প্রসঙ্গটা জটিলতার নয়, বরং ক্লেদের। কাদা থেকে
বেরোতে হবে।
এখন অবধি যা বললাম, আমার নিজের কবিতার কৈফিয়ত
হলেও হতে পারে, কিন্তু কোনো ম্যানিফেস্টো নয়। বিধি ও বিধান মেনে কবিতা লেখার যে চল
আমাদের এখানে হয়ে রয়েছে, পুনরাধুনিক কবি তাকেই ভাঙবেন। উচ্চারণ ও বাক্যের কোনো আকাঙ্ক্ষা
থেকে তিনি গা বাঁচিয়ে চলবেন না। ২০০০ পরবর্তী পরিসরে যে কবি কবিতা লিখতে আসছেন,
তিনি কেন তাঁর পূর্ববর্তী কবিতার ফসল নিজের গোলায় তুলবেন না? তিনি তাঁর আগে হয়ে
যাওয়া সব কবিতার উত্তরাধিকার আগে জারিত করুন, ও পুষ্টিমূল্যে তার শোধ নিন। তিনি
চাইলে পয়ার লিখতে পারেন, তিনি চাইলে অনুপ্রাস ব্যবহার করতে পারেন, অন্ত্যমিল দিতে
পারেন, ছড়া লিখতে পারেন, তিনি যা চাইবেন তাই করবেন, যা চাইবেন না করবেন না। মাইকেল
বা রবীন্দ্রনাথ কি সেটাই করেননি?
একমাত্র স্বাধীনতা ছাড়া একজন পুনরাধুনিকের অন্য
কোনো বাধ্যবাধকতা যেন না থাকে। পুনরাধুনিক কবিতা একমাত্র মুক্তির কবিতা হোক। মুক্তির ধারণাটুকু ছাড়া কোনো বন্ধনই সেখানে থাকবে না। এবং, পুনরাধুনিক কবিতা অন্যান্য মাধ্যম থেকেও যথেচ্ছ
রসদ নেবে। পুনরাধুনিকের পরিসর হাইব্রিডিটির নয়, অবশ্যই, কিন্তু সার্বিক
মেলবন্ধনের। মৌলিকতা একটা অসার ধারণা। আঙ্গিকের শুদ্ধতা আঙ্গিকের বদ্ধতা হতেই পারে
না। এই পরিসরের কবিতায় থাকবে নির্বাক চলচ্চিত্রের মন্তাজ ও অতল দৃশ্যগুণ, সবাক
চলচ্চিত্রের ধ্বনি ও দৃশ্যকে মেলানোর মুন্সীয়ানা, চিত্রকলার গভীরতা, গানের নিবেদন
ও প্রান, নাচের একাধারে দক্ষতা ও স্বতঃস্ফূর্ততা, ফোটোগ্রাফির বস্তু ও বস্তুকে
পেরিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা, এমনকি স্ল্যাপস্টিকের বুদ্ধিদীপ্ত মজাদার উদ্ভাবনীশক্তি,
ভিডিওর আভাস, পারফর্মেন্সের আত্মবিশ্বাস। কবিতাকে
নতুন হতে হয়, কবিতার বাইরে গিয়েই, কিন্তু কবিকে কাজ করতে হয় তাঁর নিজস্ব কবিতার
ধারণার মধ্যে, সেই ধারণা তাঁর অর্জিত পারে অথবা নিজেই গড়ে নেওয়া। তাঁর কবিতার
ধারণাটির বাইরে সেই কবি কোথাও নেই, থাকতে পারেন না। এবং,
পাঠক, কবিতার ধারণা কখনই পর্যাপ্ত হতে দেয় না নিজেকে, সে অশেষ ও অফুরন্ত। একজন পুনরাধুনিক কবি ২০১৫-র
কবিতাই লিখবেন, কিন্তু তা যেন ২৫১৫-র পাঠকের আদর পায়, যেটা আজও কাহ্নপাদ ও
ভুসুকুপাদরা পাচ্ছেন।
যদি কাঁদাতেই হয়, ২৫১৫-র পাঠকের চোখের জল লোনা
হোক, হে কবি। হে পাঠক, প্রণাম রইল।
আমার জন্য অবশ্য পাঠ্য ছিল। একশ বা তার বেশি বছরের কবিতা চর্চা বিশ্লেষণে আর পুনরাধুনিক শব্দের বহুতর দিক আলোচনায় ব্লগে আগে এটা পড়া হয়নি। বাংলা কবিতার পাঠকের কাছে বেশ জরুরি
ReplyDeleteখুব জরুরী লেখা, পাঠ্যসূচী তে থাকলে কেমন হয়?
ReplyDeleteতাগিদের অনুভবে পড়তে চাওয়া
ReplyDeleteপোস্টমডার্ন বা উত্তরাধুনিক এই শব্দ দুটি নিয়ে আমার বরাবরই গাত্রদাহ। আমি মনেমনে (একবার চিঠিতে লিখেওছিলাম কবিবন্ধু স্নেহাশিস পালকে) বরাবরই অন্য একটি শব্দের অ্যাডভোকেট, তা হল "পরম আধুনিক"। আপনার পুনরাধুনিক নিয়ে শ্রীযুক্ত প্রভাত চৌধুরীর যতই অ্যাংজাইটি থাক, আমি এই শব্দটিকে আমার বৌদ্ধিক ডায়েটের মধ্যে নির্দ্বিধায় স্থান দিতে পারি এবং দিয়েছিও ইতিমধ্যে। আমি এটিকে পরম-আধুনিকের নিকট প্রতিবেশী
ReplyDeleteবলেই মনে করি।