সমীর রায়চৌধুরী
অনেক প্রাণের
উঠোন পেরিয়ে মানুষের প্রানময়তার
উৎসব আজকের কবির কবিতায়। সেই প্রাণময়তা দেখা দেয়
অজস্র ঘটমান আর সম্ভাব্য
দৃশ্য ও দৃশ্যবোধের মাধ্যমে। এই বোধগুলিকে আক্ষরিক বায়োস্কোপে
ধরে রেখেছেন কবি অনুপম
মুখোপাধ্যায়। তরুণ কবি
অনুপমের দ্বিতীয় কবিতার বই। অনুপম এই স্বল্পকালের মধ্যে
অনেক রকমের কবিতা লিখেছেন। সাধারণত প্রকাশ করেন কবিতাগুচ্ছ। প্রত্যেক কবিতাগুচ্ছে পরীক্ষা-নিরীক্ষার
আলাদা দৃষ্টান্ত তুলে ধরেন। কাজ
করেছেন ভাষার আওতায়, ভাষার অশেষ
সম্পদ নিয়ে, আবার ভাষার
খেলা থেকে বেরিয়ে প্রবহমান
জীবনের নৈঃশব্দ্যের অনবচ্ছিন্নতাকে তুলে ধরেছেন প্রকৃতিস্থ বৈভিন্ন্যের
জটলায়। বর্তমান কাব্যগ্রন্থে
দ্বিতীয় ধরণের খেলা। অথবা
উভয় খেলা অনায়াসে মিশিয়ে
দিয়েছেন।
... দেশলাই জ্বালানোর চৌষট্টিটা প্রোসেস
আছে ... তুমি
তিনটে জানো ...
আবার মনে
করিয়ে দেন যে,
'টিভি চালাতে গিয়ে
টেবিল ফ্যান চলতে
শুরু করে ...' (পৃ. ২২)
'পেটের বাড়ে' (পেটের তাগিদে
বা জন্যে)-র মতো
আদিবাসী শব্দ আছে, 'স্পনসর' ইংরেজি শব্দ
বা
'আদুল' দেশজ আর 'বেকারার' হিন্দি ফিল্মি
শব্দও আছে। লিঙ্গুয়াল
স্পেস বাড়িয়ে দিতে চেয়েছেন। সম্ভাব্য পাঠক ও কবি
দু'জনে
মিলে ওই চৌষট্টি প্রোসেসের
সুরের দিকে রওনা দিয়েছেন। সুরেই আগুন ধরাতে চান।
এই বইয়ে
সেই নৈঃশব্দ্যের জ্যামিতিক
সংলাপ শুরু হয়ে যায়
প্রচ্ছদ থেকে; প্রচ্ছদের দুটি
দিক,
পেছনের মলাটে ব্লার্ব, যা নিয়ে
পরে কথা বলা হয়েছে। প্রচ্ছদ এঁকেছেন চলচ্চিত্রকার বুদ্ধদেব
দাশগুপ্ত। তাঁর আঁকায়
দেখা যাচ্ছে কবির দৃষ্টিভঙ্গির
ড্রইং আর কবিতার দৃশ্যগুলির
বহুত্বময়তার একীকরণের পর্যবেক্ষণের তির্যক
বিন্দু। অন্যদিকে চোখের
বাইরে বেরিয়ে গেছে অক্ষরতুলিকার
রেখাঙ্কন। চোখ মলাটের
আয়তক্ষেত্রের ধনুৰ্মার্গে, আর দৃষ্টিরেখ
সেই অনুপাত ধর্মিতার সাপেক্ষে। আজকের কবির এই আক্ষরিক
আলেখ্যাপটকে অনেকটা খোলসা করে
দিতে চেয়েছে জ্যেষ্ঠ কবি
চিত্রশিল্পীর আঁকন।
মলাটের প্রচ্ছদকাহিনিতে আছেন আরও বিশিষ্ট কবি, কবিতা
ক্যাম্পাসের পক্ষে প্রকাশক অলোক
বিশ্বাস। অলোক ১৯৯৮
সনে একবার বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের
বাড়িতে গিয়েছিলেন তার পত্রিকার
জন্য একটি মলাটের স্কেচের
আশায়, বুদ্ধদেব স্কেচ পেনে
এঁকে দিয়েছিলেন দুটি। অলোক
একটি স্কেচ সেই সময়ে
ব্যবহার করেছিলেন 'কবিতা ক্যাম্পাস'
পত্রিকার মলাটে। অন্যটি
তাঁর কাছেই ছিল এতদিন। অনুপমের কবিতার পাণ্ডুলিপি পাওয়ার
পর তাঁর মনে পড়ে
যায় সেই সযত্নে রাখা
স্কেচটির কথা। অতএব
এভাবে মলাটে যোগ হয়ে
যায় তিন কবি ভাবনার
ত্রিবেণী সঙ্গম। পাঠক
হিসেবে বইয়ের প্রচ্ছদ দেখ
মনে হয় অলোকের অপেক্ষা
ব্যর্থ হয়নি।
... সত্যের সঠিক
মাত্রা ... সত্যের আরেক
নাম জ্বর ... প্যারাসিটামলগুলো ...
ক্রমেই নিরাপদ
হয়ে আসছে ...
বিছানায় আয়না ... আয়নায় বিছানা ... বৃষ্টির শব্দ
থাকুক বৃষ্টি না
থাকলেও ... (পৃ. ৩৬)
প্রকৃত ও প্রতিফলিত,
সত্যের মাত্রায় অহরহ বৈলক্ষণ্য
যোগ করে দেখনভঙ্গি, একই আয়তনে
প্রবেশ করে গ্রহণের বহুত্ব
গড়ে নিতে। চোখের
অনেক নাম, নয়ন ... আঁখি, নেত্র, লোচন ... দৃশ্যের বিশ্লেষণে
তা তর্জমায় নামের সেই
পার্থক্য বা বৈভিন্ন্যের পরিচয়
গ্রাহ্যের মাত্রায় রকমফের গড়ে। রোধের কোনো তহবিল একমাত্রিক
নয়। চোখের পাতা
আর আঁখিপল্লব দুটি পৃথক
সমার্থক শব্দ সমঅর্থবোধকতা থেকে
সরিয়ে দেয় গ্রহণের সকল
জ্যামিতি। শব্দের ও শব্দজনিত
বোধের দৃশ্যগত এই মাত্রা
টের পেতে দৃশ্যের বৈভিন্ন্যে
নিয়ে যান অনুপম। আমরা
টের পাই বৃষ্টির টুপটাপ-এর
কত মতিগতি আর আলোর
রোশনাই কত রকমারি। টের
পাওয়ার আদরাগুলোকে নতুন
করে যাচাই করেন ভিন্ন
বাগধারায়। দেখে নেওয়া
আর দেখে রাখা বৃষ্টির
শব্দের ভৌগলিক এক নয়। বিছানায় আয়না আর আয়নায়
বিছানা শব্দার্থের পারস্পরিকতার
গণিত অনায়াসে বদলে দেয়। পাঠপতিক্রিয়ায় বোধের গভীরে এই
মাত্রাবোধ উপস্থিতি আর অনুপস্থিতি
পারস্পরিক সম্পর্কের অবস্থান ও ভূমিকায়
অদলবদল ঘটায়।
বাসের ছেঁড়া
টিকিট ... গড়ান
কাহিনী ... কাচে ... মৃদু চিড় ... সঠিক দেখাশোনা ... (পৃ. ১৯)
অনুপম কবিতাগুলির
পৃথক পৃথক কোনো শিরোনাম
দেননি আবার কোথাও বলেননি
যে দীর্ঘ কবিতা। পাঠক্রিয়ার
জন্য দেদার ছুট। তিরিশ
পাতা ধরে ক্রমাগত উঠে
এসেছে দীর্ঘ ভাষ্য, কোথাও প্রয়োগ
করেননি যতিচিহ্ন। এড়িয়ে
গিয়েছেন কবিতা ও ভাষাআয়োজনের
যাবতীয় চিহ্নায়ন। কেবল
লেখন বিষয়ের বৈভিন্ন্য বজায়
রাখার জন্য লিডর (...) চিহ্ন
ব্যবহার করেছেন, চলমান ধারাভাষ্যের
ধারাবাহিকতা বজায় রাখার সংকেত
হিসেবে। অনবচ্ছিন্নতার বোধ
বহাল রাখতে চেয়েছেন লিডার
(...) চিহ্নের সাহায্যে। জীবনের
সবটাই লাইভ পারফরম্যান্স। লাইভ
পারফরম্যান্স কোনো তুলে ধরা
আলাদা নয়।
অনুপম থাকেন
পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ঘাটালে, কলকাতা
থেকে দূরে, ফলে কলকাতা
মন্য কবিতাভাবনার গত
থেকে দূরে, খোলা হাতে
দরাজভাবে খেলতে পারেন এখনও। প্রিমডার্ন, মডার্ন, পোস্টমডার্ন ইত্যাদি
খোপের খেলায় যাওয়ার প্রয়োজন
হয় না তাঁর। তাঁর
কবিতা কোনো ভিত্তিবাদী ধ্যানধারণার
ওপর ভর করে রচিত
নয়। অবলীলায় মিশিয়ে
দিতে পারেন তাঁর স্বতঃস্ফূর্ত
ভাবনাগুলোকে। সচেতনভাবে এড়িয়ে
যাওয়ার চেষ্টা করেন চিহ্নায়ন
পদ্ধতিগুলোকে। এমনকি নামকরণেও
সেই একই খেলা দেখা
যাচ্ছে। নাম যেন
স্থিরীকৃত না করে দেয়
নিরবচ্ছিন্ন ভাবনার বিপুল যাত্রাকে।
রোগা মেয়েগুলো ... যুদ্ধে থাকুক ... ভালোও থাকুক ... আমাদের ... / বাসের উইন্ডস্ক্রিনে শুকনো গাঁদার
মালা নয় ... নিরবচ্ছিন্ন ... অথচ অপরাজেয় ... / যার নাম
অপরাজিতা, সেও কিন্তু
নামকরণে হেরে যায় ... / ইস্কুলের দিদিমণিদের জয় ... আপনি
দেখুন ... (পৃ. ৩২)
কোনো রৈখিক
সময় ধরে ভাষ্য সাজানো
হয়নি, ফলে সমধর্মী যুক্তির সাহায্য
গ্রহণের দরকার পড়েনি। অথচ এলোমেলো নয়। অবচ্ছিন্ন কখনোই নয়। পথে
দেখা দৃশ্যের সঙ্গে অবলীলায়
মিশে গেছে ভেবে দেখা
দৃশ্য, চিন্তার স্বতঃস্ফূর্ত ছবি। টিভিতে দেখা দৃশ্য; আবার স্বপ্ন
আর স্মৃতির দেখাদেখি হয়ে
যায় একই মুহূর্তের মিথুনচক্রে। রৈখিক সময়বোধে বাস্তবের মাত্রা
আর গতিপ্রকৃতির তর্ক
ও ঔচিত্য থেকে যায় গাণিতিক
কারণে সেখান থেকে সরে এলে তর্কের ভূমিকা ফুরোয়। শুরু হয় চেতনার মুক্তযাত্রা।
আজ তামাক
বিরোধী দিবস নয়
... মাদারস ডে নয়
... জীবনানন্দ জন্মান নি / আজ
.../ কোনো টাইম মেশিন
আজ স্টার্ট নেবে
না
... (পৃ.
১৯)
দিনটি চিহ্নিত নয়। রিয়্যাল টাইমেই আছে আর সব দিনের মতো। সবার বা অনুপমের দিন হয়ে যেতে কোনো খোঁচ নেই। দিনটি আর কারও বা কারওর জন্য এক্তিয়ারভুক্ত নয়। ব্যক্তিপ্রকল্পের অধীন নয়। একটি দিনের পূর্বনির্ধারিত সজ্ঞায়নের অর্থ প্রকৃতির ওপর স্বামীত্ব প্রকল্পের বিস্তার। আগেভাগে দিনটির আর কেউ মালিক নয়। অনেক দিনের মতো আরও একটি দিন, প্রকৃতিজাত দিন, কবির যখন যেমন ইচ্ছের দিন। পূর্বসংজ্ঞায়িত 'দিবস' নয়। আশপাশে কত কী ঘটছে, কবি দেখছেন আরও অনেককিছু। কিন্তু চিহ্ন প্রয়োগ করে স্থিরীকৃত রেখে সেগুলোকে দখল করার ইচ্ছে নেই অনুপমের। তিনি জানেন, বৈয়ক্তিকের সীমা কোথায় মিশে যায়।
অনুপমের কথা
ভেবে কেউ সিনেমা
বানায় না
... ভাস্কর্য গড়ে না
... কফির তলানিতে ইতিহাস
নেই...
টোস্টের গুঁড়ো আছে
... /অনুপমের কথা ভেবে
কেউ টনিক বানায়
না...
আকাশ মোছে না.../
মেঝেও মোছে না
মাঝে মাঝে
... (পৃ.
২১)
টুকরোটাকরা ঘটনাগুলি তাঁর চোখে পড়ে যায়। কবি যুক্ত হয়ে পড়েন সেই ক্রিয়মানতার সঙ্গে। আবার শরীরও শামিল হয় সেই স্বতশ্চল, স্বতঘটনের ঘটনাচক্রে।
...
কাপড় কাচার উচ্চকিত
আওয়াজ
... ঢেকুরের আলতো শব্দ
...
উপরে উঠেও মিশে
যায়
(পৃ.
৯)
বেগুনপাতায় টুথপেস্টের
দাগ
... একটা কাঠের পাটা
হঠাৎ যায়না হয়ে
ওঠে
... (পৃ.
১০)
এভাবেই ক্রমাগত দেখা যায়, 'হাতের চেটোয় মাদুরের দাগ', 'গরুর মুখে ঘাস ছেঁড়ার আওয়াজ',
'ঝিমোনো গাধার চোখ', 'চুলের ভাঙা ক্লিপ',
'টেবিল ফ্যানটা তোমার দিকে নেই', 'বাদুড়ে খাওয়া পেয়ারা',
'ডিলিসাস সুগারদানা কাঠপিঁপড়ের মুখে', 'পুরোনো জিনসে রোদ পড়েছে',... এ সমস্তই তাঁর দৈনন্দিন থেকে সংগ্রহ। স্থানীয় স্কুলে অনুপম ইংরিজির শিক্ষক। যাতায়াতের পথে এভাবেই কত কি চোখে পড়ে। কিন্তু কোনো একটি দৃশ্যকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরছেন না। সব দৃশ্যই প্রবহমানতার অবিচ্ছেদ্য স্ফুরণ।
...
পিচগলা রাস্তা
... ভাইবোন কুলপি ভাগ
করে খাচ্ছে
.../জরির কারখানা থেকে
সমস্ত জরি বাতাসে
.../খাতা উঠছে কবিতায়
... (পৃ.
৭)
বইয়ের প্রথম কবিতার প্রথম স্তবক, শুরু হচ্ছে লিডর দিয়ে অর্থাৎ এই যে কোনো এক জায়গা থেকে শুরু করলেন আর কী ! 'পিচগলা রাস্তা' সময় এবং পরিস্থিতির সংকেত জানায়,
'ভাইবোন কুলপি ভাগ করে খাচ্ছে' ভেদসহ অভেদের দৃশ্য বা হারমনি তুলে ধরছে। সম্ভবত কবির চেনা কিশোর-কিশোরী, কেননা ভাইবোন বলছেন, লক্ষ করেছেন যে কুলপি ভাগ করে ওরা খাচ্ছে। কিন্তু সেখানেই ধরে রাখছেন না পাঠ প্রক্রিয়াকে। তাঁর লক্ষ্য মেলোডির দিকে যাত্রা। পরের পঙক্তিতে এসে যাচ্ছে জরির প্রসঙ্গ। প্রথম লাইনের সঙ্গে দ্বিতীয় লাইনের যোগসূত্র খোঁজার দরকার নেই। পরের স্তবক শুরু করছেন
...
আজ পর্যন্ত চিন্তার
ছবিতেই কেবলমাত্র ভোর
হয়
... (পৃ.
৭)
জরির প্রসঙ্গ এমনই চিন্তার ছবি. ঘাটালে হয়তো জরির কারখানা আছে। তা বলে 'সমস্ত' জরি বাতাসে চলে আসবে না। একই কবিতার মধ্যে যেমন নিরপেক্ষ কৌতূহলের বয়ান আছে ঠিক তেমনই 'সামাজিক আচরণবিধিতে পরিবর্তনের সংবাদ যোগ হয়েছে। 'ডিনারের নেমন্তন্নগুলো ... ককটেলের নেমতন্ন হয়ে যাচ্ছে ..., (পৃ. ৭) আবার কীটনাশকের দোকানে ডিজেল বিক্রী হচ্ছে... (পৃ. ৩০) উঠে আসছে স্থানীয় জীবনের গোলমালগুলো। অথচ ভালোমন্দ, উচিত-অনুচিতের প্রসঙ্গ তিনি তোলেননি। কেবল সংবাদটুকু জানিয়েছেন। আমিত্বের গঠনে যে বৈভিন্ন্যের সমাবেশ তা আইডেনটিটি থেকে আলাদা, সাবজেক্টিভ। ক্রমান্বয় খোঁজার চেষ্টা থেকে বিরত থাকার জন্যে সময়ের প্রসঙ্গটি বারবার এসেছে। অথচ সময় থেকে সরে এসে অবস্থানপন্নতায় নজর দিতে বলেছেন। অথচ সময় অবশ্যই একটি অনুষঙ্গ, কিন্তু সেই সময় 'পাখনাসমেত জমে থাকা' শব্দের সান্নিধ্য গ্রহণ করে না। স্থির থেকে পাখনা বা উড়ালে সরে যেতে এই ক্যালেন্ডারের হারিয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক।
...
বৃষ্টির দিকে দেখুন ... কেননা বৃষ্টিতে
আলো উঠেছিল ... কেন না
রেনকোটগুলোর মধ্যে কিছু
পাখনাসমেত শব্দ জমেছিল ... (পৃ. ৩৬)
বৃষ্টির মধ্যে
একটা ক্যালেন্ডার হারিয়ে
যাচ্ছে ... তারিখ ছাড়াই ... তাৎক্ষণিক
বক্তৃতা ছাড়াই ... ' ঘড়ির কাঁটায়
শুকনো হয়ে সময়
জমে আছে... ঘড়ি...
আহা...অচল
ঘড়িখানা...
ঠিক এসবের পাশাপাশি টিভিতে দেখা দৃশ্য কবিতায় জায়গা করে নিয়েছে। এমনভাবে মিশিয়ে দিয়েছেন যেন সবকিছু দেখা যাচ্ছে একই ক্যামেরার ওয়াইড অ্যাঙ্গেল লেন্সে, যেহেতু সামায়াপন্নতার ঝকমারি নেই। অতএব সেই লেন্সের ক্যানভাস অনায়াসে অনন্তকে বাগে আনতে পারে।
১. মেরুভল্লুকের মুখে সিলমাছের
তাজা রক্ত ... গরম ... বরফের গুঁড়োগুলো
জল হতে চাইছে ... (পৃ. ১৪)
২. ... নদী
থেকে ফিসফিসিয়ে বরফ
জমার শব্দ ... (পৃ. ১৫)
৩. একটা
হিমবাহ ... নিখুঁত পাথর হয়ে
যায় ... (পৃ. ১৫)
আবার অবলীলায় সরে যান তাৎক্ষণিক বাস্তবের বাইরে। 'গাছের ছায়া তুলে এনে কুয়োতলায় কুটতে বসেছে ... পাঁশ নেই ...', ' ... তরমুজ বনে পড়ে আছে খাসি ছাড়ানোর অলৌকিক ছোরা
...' এভাবে কবিতাগুলো চিন্তার ক্যামোফ্লেজ ছিঁড়ে বেরিয়ে আসছে। মাদার'স ডে অর্থে যে চিহ্নায়নের কথা বলছেন আর 'খুব ভালো রোদ হোক
... চিহ্নিতভাবে আলাদা
... ' এই দুই চিহ্নায়ন এক নয়। ভালো রোদ তাঁর কাছে ব্যক্তিগতভাবে চিহ্নিত হোক। অথচ প্রকৃতিস্থ থাকুক। এমন কত কী চিহ্নিত হয় প্রতিমুহূর্তে অথচ কোনো স্থায়ী চিহ্নায়নের অংশীদার হয়ে ওঠে না। বরং প্রকৃতিস্থ প্রসেসের সঙ্গে রিলেট করে। তরমুজ 'বন্' বললে একই পঙক্তিতে 'ছোরা' শব্দের উপস্থিতি বেশি মানায়।
'ছোরা' শব্দে নিহিত বন্যতাকে আশ্রয় দেয়। তরমুজ খেত বললে পোষ মানানোর সংকেত হয়ে উঠত। 'ছোরা' শব্দের উপস্থিতি আলগা ঠেকত।
আলোর প্রসঙ্গ এসেছে কিন্তু এই আলো আলোকপ্রাপ্তির প্রসঙ্গের সঙ্গে যুক্ত নয়। বরং নিরপেক্ষ কৌতূহলের সঙ্গে যুক্ত।
যেমন 'কুমড়ো ফুলের আলো' (পৃ. ৩৫), 'বৃষ্টিতে আলো উঠেছিল'
(পৃ. ৩৬), 'আলো ছানার জলের মতো' (পৃ. ২১), 'অন্ধকারের কথা তুলতেই আলো হয় না' (পৃ. ২৫), 'রোগা এই স্কুলে ... ধাড়িধাড়ি আলোগুলো খুকু সেজে থাকে' (পৃ. ১৮), 'চারকোনা আলোগুলো জানলা সেজে আছে' (পৃ. ১৮), 'আলো ... ডানাছেঁড়া ফড়িঙের মতো নয়' (পৃ. ১১) ... এ সবই কবির সহজ অনুভূতির সংবাদ, এখানে কোনো তত্ত্ববিশ্ব তুলে ধরতে চাননি তিনি। লেখালেখির সমগ্র প্রকল্পে বাদ, ইজম ইত্যাদি এড়িয়ে যেতে চেয়েছেন। এমনকি নিস্পত্তিবাদের ধারেকাছেও যাননি। স্রেফ দেখে ফেলা আর ভেবে দেখার সংমিশ্রণ ও সংকরত্ব, যে কোনো জায়গায় কবিতার বয়ান শুরু হচ্ছে। আবার যে কোনো জায়গায় থেমে যাচ্ছে। কেবল বজায় থাকছে প্রবহমানতার বোধ, ফ্লাক্সের যোগসূত্রটুকু। অথচ স্বয়ংক্রিয় লেখন পদ্ধতির সাহায্য নেননি। উঠে আসছে ভাবনার তহবিল থেকে যদিও তিনি অবশ্যই এজিটেটর। আমাদের আলোড়িত করতে চান। মহাভারতে পরীক্ষিত পুত্র জন্মেজয় যেমন।
ব্লার্বে অনেককিছুই বলেছেন :
'অনুপস্থিতির
দ্বারা উপস্থিত। সকলেই
মরে আছি।
কুরুক্ষেত্রের
ভেতরে এবং বাইরে।
যুদ্ধের ভেতরে এবং
বাইরে। আকাশ তাঁর
কাছে নীল অমলেট,
মেঘগুলো পেঁয়াজ। প্লেনের
ধোঁয়া লঙ্কা। পাখিগুলো
মরিচ। নাকি জিরে
? ... আকাশে হাত রাখলে
হাত নীল হয়
না।'
আবার একটি কবিতায় বলেছেন : হলুদ রঙের টিয়াগুলো আকাশকে সবুজ করে রাখুক ...', কবি আমাদের ক্রমাগত নিয়ে চলেছেন রূপকথার স্রোতের মধ্যে। রূপকথার ক্যানভাসে যেখানে ইচ্ছে ঢুকে পড়তে পারা যায়, আবার যখন ইচ্ছে বেরিয়ে আসতে পারা যায়, কোনোরকম ছোপ না লাগিয়ে। অথচ বায়বীয় গোলকধাঁধায় নিয়ে যেতে চাইছেন না। নিয়ে যাচ্ছেন না কোনো ভুলভুলাইয়ার মধ্যে। কেবল রূপময়তার খেলায় খেলতে ডাকছেন যেভাবে জীবন অহরহ ডাকে, সজীব ও সক্রিয় রাখে। তিনি জানেন চাক্ষুষ অভিব্যক্তির সীমাহীনতা। ধরিয়ে দিতে চান প্রবহমানতার সুরটুকু। কথার চেয়ে সংগীতই যেখানে বড়। কিন্তু এভাবেই এই গ্রন্থে তিনি গড়ে তুলেছেন নিজস্ব বিশেষ বাগধারা বা বাগভঙ্গি। দেশজ প্রবাদ-প্রবচনগুলোতে যেমন শব্দ গোড়াতেই শব্দার্থ থেকে বেরিয়ে যেতে বলে, কেবল প্রবহমানতার বাগধারায় সম্পৃক্ত রাখে। চাষবাসের ধ্যানধারণার আগেই মানুষ কুকুর পুষেছিল। গোরু পোষার অভ্যেস ঢের পরে এসেছে। প্রয়োজনের চেয়ে যা সহজে প্রকৃতিস্থভাবে রিলেট করে সেখানেই মানুষ আগে গিয়েছে। কুকুরের স্বভাবে রয়েছে ঘনিষ্ঠতা, আনুগত্য, যৌথতায় যুক্ত হওয়ার প্রকৃতিস্থ আগ্রহ। দৃশ্য বা দৃশ্যবোধ এভাবেই মানুষকে কাছে টানে। প্রকৃতিস্থ সমগ্রের অংশীদার করে তুলতে। 'পোলিংবুথে যে গোরু বৃষ্টিকালীন আশ্রয় নিয়েছিল
...' এই আশ্রয় নেওয়ার মধ্যে এমনকিছু বিশেষত্ব নেই, কেবল আশ্রয়টি 'পোলিংবুথ' হিসেবে চিহ্নিত বলে এই দৃশ্যের মাত্রাবদল ঘটে। অন্য মনে হয়। অনুপমও চিহ্নায়নের চরিত্র ও ভূমিকা স্পষ্ট করে তুলতে চান। তাঁর নিজস্ব সহজ পদ্ধতিতে কেবল দৃশ্যের গাণিতিক ধরতাইয়ের আশ্রয় নিতে হচ্ছে না।
ঘড়ির প্রসঙ্গ অনুপমের কবিতায় বারবার এসেছে। হয়তো সালভাদর দালিকে মনে পড়তে পারে। উপস্থিত আর অনুপস্থিতি সংমিশ্রণ থেকে হুইটম্যানকে মনে পড়তে পারে। কিন্তু এই মনে পড়া পাঠকের বিষয়, কবির উপস্থাপনের লক্ষ্য নয়। 'গাছের ছায়াই তো গিলে নেয় পাখিদের ছায়াগুলোকে' ... এখানে ছায়া নিয়ে যত না বলছেন তার চেয়ে বেশি আমাদের কাছে তুলে ধরছেন পাখির উপস্থিতির অনুপস্থিতি। কবি কোথাও নিজের উপস্থিতি সহ ঢুকে পড়ছেন না। ক্যামেরা ঘুরছে নিরপেক্ষভাবে। তদন্তকারীর ভূমিকা অনুপস্থিত।
উঠে আসছে ক্রমান্বয়বিহীন। অথচ 'ছেঁড়া পাঠক্রিয়া' মনে হয় না।
... তোমার
হাসিকান্নার কোনো সবুজ ফাইল
নেই ... লাল ফাইল
নেই ... / তুমি একা
একা পরিবাহী ... / শুকনো ঘাসের
ভাষা তুমি আজও শিখবে
না
... ভাস্ক ... (পৃ. ১৭)
তুমি একা একা পরিবাহী, এই বোধটুকুই তিনি আমাদের জানাতে চান। 'ভাস্ক' এখানে কবি ভাস্কর চক্রবর্তীকে স্মরণ করায়।
গরমাগরম খাবার থেকে ধোঁয়া উঠছে। ... তন্দুরী ... চিকেন ... কাবাব ... পরোটা কিন্তু খাবারের অন্য নাম মৃত ... খাবার শরীরের গৃহীত হয়ে যাবার পরেই তা পুনর্জীবন লাভ করে। মানুষ আর শকুনিরা মৃত খাবার খায়। তবে মানুষের আয়ত্তে ও অর্জনে আছে রান্ধনশিল্প, যা তার বিবর্ধনজনিত অর্জন। শকুনি থেমে আছে তার বিবর্তনজনিত অবস্থানে। কবিতা স্বয়ং বিবর্ধনের ফসল। প্রতিনিয়ত প্রত্যেক প্রজন্মে যে কারণে বদলে যাচ্ছে। কবিতা আর রন্ধন শিল্পে একই লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডে পরীক্ষা নিরীক্ষা ঘটে চলেছে, যার শেষ নেই।
একটি দীর্ঘ্য অনাবরণীকরণ প্রক্রিয়া। যাওয়া আসার পথে একটা পাঁচিল লতা-গুল্ম-শ্যাওলায় সবুজ হয়ে গেছে। কবির মনে হল সুররিয়াল সবুজ পাঁচিল
... তা বলে তিনি পরাবাস্তবের দিকে নিয়ে যেতে চাইছেন তা নয়। ঠিক যেমন : বেনাঘাসের শীষগুলো
.. দুলছে চিহ্নায়ন ছাড়াই ...
বাইরে যা ঘটে মনে গৃহীত হয়। পুনরায় মনের মধ্যে ঘটে। মনের বাস্তব মানুষের জৈবঘড়ির কাঁটায়। জীবন এক সমগ্রে তাকে নিয়ে তার ভাবনায় চাষবাস সারে। সেই ফসলে জাবর কাটে। ফলে বোধের এক সম্প্রসারিত চেতনার জৈব পর্যায়ক্রম কার্যকরী হয়ে ওঠে। মূর্ত আর বিমূর্ত পাশাপাশি জাগে, যেমন খাসি ছাড়ানোর ছোরাকে মানিয়ে যেতে তরমুজের পাশে 'বন' শব্দ আসে। যে আনয়ন করে তাহাই নয়ন, তখন চোখ নয়। এখান থেকে কথা ওঠে শব্দব্রহ্মের, অব্যয়, কালাতীতের। সময় নিরপেক্ষ অবস্থানের, কৌতূহলের নিরপেক্ষতার। তখন সেই ভাবনার ফসল কবির একার নয়, ব্যক্তিএককের অধীন নয় বরং পাঠক্রিয়ার অংশগ্রহনকারীর আমন্ত্রণ উৎসুক। অনুপমের কবিতা এই কার্যকরী স্পেস গড়ে দেয়। বন্যতাকে মানুষ পুরোপুরি বর্জন করে নি। এখন আরও গভীরভাবে জেনেছে কেন এই জীব উপাদান স্বাভাবিকতার প্রশ্রয়। 'মেরুভল্লুকের মুখে সিলমাছের তাজা রক্ত ...' এর পাশাপাশি অনুপম জানিয়েছেন '
... গরম ... বরফের গুঁড়োগুলো জল হতে চাইছে ...' ।
মেরুভল্লুকের তাজা রক্তের খিদে বা ইচ্ছের সঙ্গে বরফের জল হতে চাওয়ার ইচ্ছে মিশে যাচ্ছে। প্রকৃতিস্থ ভারসাম্য গড়ে দিচ্ছে বোধের ঔচিত্যবোধ। একই গাণিতিক পর্যায়ে রয়েছে 'বন' ও 'ছোরা' ; ঔপনিবেশিকতা প্রভাবিত 'লৌকিক' বোধ সময় অনুগত বা রৈখিক সময়ের অধীন, অতএব 'ছোরা' শব্দের আগে এসেছে অলৌকিক 'ছোরা' (পৃ. ১৪) । এই ভারসাম্য আমাদের স্বস্তি দেয়, প্রকৃতিস্থ তৃপ্তি জানায়।
অতএব জানিয়ে রেখেছেন :
সময় থেকে
স্থান গলে পড়ছে ... টুপটাপ...টুপ্...
টাপ...
টু
...
ব্রিটিশদের জনজীবনে সময়বোধ আঁটোসাঁটো, ফরাসিদের সময়বোধ অবস্থানসাপেক্ষ তাঁরা বলেন 'দুরি'; পুরাণে, উপনিষদে, সনাতন ভারতীয় সময়বোধের সঙ্গে অনেকটা মিলে যায়। ঔপনিবেশিকতার প্রভাবমুক্ত হওয়ার পরেও টের পাওয়া যায় পণ্ডিচেরি বা গোয়ার জনজীবনের ভিন্নতা।
এভাবেই প্রবহমান ঘটছে বিশ্বভুবন জুড়ে, ঘটছে আমাদের মনের ভুবনে, ঘটছে বোধে ও চেতনায়। লক্ষ করুন ' ... টুপটাপ ... টুপ্ ... টাপ
... টু ...' প্রসেসটাকে, যা থামে না ; লৌকিক থেকে উদ্ধার পেতে 'অলৌকিক' ডাকে। মনে পড়ে বৃষ্টির শব্দ, বৃষ্টির শব্দ থাকুক বৃষ্টি না থাকলেও। 'টু' শব্দের মতো ভাঙা শব্দে তাঁর কবিতার বহু পঙতি চলন রাখে।
'তবু ... তবু ত' (পৃ. ১৪) 'পশ্চিমব...
ভার...ত
...' 'কেউ চুমু খায় না
... খায় না
... খ ... ' প্রসেস চলমান, বহমান আবার 'গলে আসা নকুলদানা ... অনিশ্চিত ইলেক্ট্রন ... ছ' (পৃ. ৩৬) ; ছ কিসের ছ
... সে কী ছায়া যা সময়ের পরিবর্তনের অধীন ! পাঠকের জন্য ভাবনার ছুট।
খোলামেলা স্পেসে যাওয়ার প্রশ্রয়সূচক। এই ভারসাম্য বা স্বস্তির জায়গা কবির 'অহং'কে দূরে রাখে, সার্বজনীন হওয়ার আমেজ বা আহ্লাদ তৈরী করে। কৌম পারস্পরিকতার স্পেসে নিয়ে যায়।
যেজন্য অনুপমের কবিতায় আসে প্রকৃতিস্থ আহ্লাদের উচ্চারণ :
মশারিতে ফুটো
রাখা ভালো ... মশা
নয় ... জোনাকিদের জন্য ... (পৃ. ১৯)
বুনোখেজুরপাতার
বোনা চাটাই ... কুলিয়ে যাবে
সবার শোয়াবসা ... (পৃ. ২৮)
'আমি'কে গোপন রাখেন, একথা সে কথা বলার ফাঁকে যোগে করেন 'তোমার জন্য' 'সবার', 'দেখুন',
'দ্যাখো'। কবি সঙ্গে আছেন, কোনো উঁচু পৃথক পাটাতন থেকে হাতে মাইক ধরে কথা বলছেন না। থেকে থেকে অহরহ দীর্ঘ ভাষ্যের আনাচেকানাচে সঙ্গগ্রহণের ইশারাগুলি বজায় রাখছেন। যেন পুরুতঠাকুর সকলের মঙ্গলের জন্য মন্ত্র পড়ছেন।
প্রতিনিয়ত চিন্তাচেতনার বাস্তব স্বয়ং রূপকথা, ভুবনমেলায় তার বহুত্ব থেকে আলাদা করে নিলে অ্যাবস্ট্রাক্ট থেকে কংক্রিটাইজ করা যায় বা সেই রূপকথা থেকে সরে আসা যায়। আজ যখন এ কথা লিখছি টিভি আর কাগজ পড়ে জানতে পারলাম 'আন্তর্জাতিক নারী দিবস'; বউকে নিয়ে ডেন্টিস্টের চেম্বার থেকে ফিরেছি, সঙ্গে পেনকিলার বড়ি। এখন প্রকৃত বোধ বড়ো নির্দয়, সহায় ওই ছোট্ট বড়িটার এই মুহূর্তের অপেক্ষমাণ সত্য, সংসারে হাসি ফুটবে। মন যখন শরীর। ওই পেনকিলার বড়ির ভেতরে আছে যন্ত্রণার মুক্তির রূপকথা।
... কী দেখা
দিল .../দুটো অসুখের
মধ্যে আরেকটা অসুখ ... অল্প মাজা
দাঁত ... ভেজা ট্যাবলেট ... / এলোপ্যাথি আর
হোমিওপ্যাথির মধ্যে চ্যবনপ্রাশের ডিবে .../
কী দেখা
দিল...
ঘাসবনে লুকিয়ে আছে
শুকনো লঙ্কাগুলো ... (পৃ. ২১)
স্কুলের দিদিমণিই
বৃষ্টি হয়ে ভিজিয়ে
দিতে পারেন মন, শরীর
জুড়ে মন। শরীর
যখন মন।
...
দিদিমণিতে ভিজে যাচ্ছে
দিন ... বাতাবি ... ক্লাসগুলো সব ... (পৃ. ১৮)
ওই 'বাতাবি' শব্দটিতে আছে পাঠকের মুক্ত স্পেস আর কবির গোপন, সহজবোধ্যের মাঝখানে এই আপাত ঝাপসা অথচ একটি চেনা শব্দ।চ্যবনপ্রাশের ডিবে। চিরকাল পাঠস্মৃতির শিকেয় ঝুলবে, দিদিমণির বুক জুড়ে ঘুরঘুর করবে নিছকই। অথবা অলৌকিক বৃষ্টিতে ভিজে গড়াগড়ি দেবে।
...
অনেক বৃষ্টির পরে ... পুরনো ... পাতাগুলোর ধুলো যায়
না .../ ইলিশমাছের পাতুরি
থেকে কলাপাতা ফসকে
যায় ... চিতলমাছের মুঠি
থেকে / শালপাতা ফসকে
যায় .../ একটা পাকুড়
গাছ ... খুব অদ্ভুত হয়ে উঠছে .... বেকারার হয়ে
উঠছে ... (পৃ. ১৯)
বৃষ্টি অনুপমের বড়ো প্রিয় অনুষঙ্গ ;
জলরাশির ভূভাগ থেকে আকাশবাসী হয়ে ফের মাটিতে নেমে আসায় এই ঘটনাচক্র বা জৈবচক্রের অনুভূতি তাঁকে প্রকৃত আর প্রচ্ছন্নের সম্পর্কের হদিস দেয়, প্রগমনের মনন দেখায়।
...
প্রচুর বৃষ্টিতে ধুতরোর
ফুল ... মরিয়া ... প্রকাশ খুঁজছে ... স্পনসর খুঁজছে ... / বৃষ্টি জলরং
আলো
... তেলরং ছায়া ... /টেবিলে নেতিয়ে
আছে স্যাঁতা হাতপাখা ... / অমরত্বের পোকাগুলো ... চরছে না
কোথাও ... / এই ... প্রমাণিত মানচিত্রছাড়া ... ভার্চুয়াল বাস্তবের
দস্তানা ছাড়া ... (পৃ. ২০)
'বাতাবি' শব্দের ভোগান্তি থেকে নিষ্কৃতি দেয় 'ধুতরোর ফুল' তার প্রকৃতিস্থ অবস্থান। 'বাতাবি' যে বৃষ্টিতে ছিল আর 'ধুতরোর ফুল যে বৃষ্টিতে মরিয়া উভয় একই জৈবচক্রের উৎপন্ন তবু অবস্থানজনিত পার্থক্যই ভার্চুয়াল ও রিয়্যালের দোলাচলে রাখে, অথচ উভয় ভেজায়, জলরং আলোর সঙ্গে তেলরং ছায়া রেখে যায়। এই বৃষ্টির বিস্ময় পাঠবস্তুর রহস্যে সীমায়িত থাকে। পাঠবস্তু থেকে বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার খোরাক জুটিয়ে দেয়। চেতনার প্রসারণে সাহায্য করে। সবাই ও সবকিছুকে নিয়ে নিজেকে ভোগ করার আনন্দ জানায়। একটি দীর্ঘ পাঠক্রিয়ার মাধ্যমে যখন নিজেকে স্বীকৃতি দিতে পারছে, মজা করতে পারছে, যা কিছু তাকে সায় দিয়ে রেখেছে তা শনাক্ত করতে সমর্থ হচ্ছে তখনই পাঠবস্তু তার কাছে যথার্থ। অনুপম বেশ সাবলীলভাবে যা পেরেছেন। তখন, 'সাদা কাকাতুয়ার ঠোঁটে জলদস্যুর হলুদ প্রেমকাহিনি
...' তেমন বিবর্ণ থাকে থাকে না। শুনতে পায়, 'কোথায় যেন ভানু ব্যানার্জী বেহালা বাজাচ্ছেন
... রবি ঘোষ শুনছেন ...' আর জানতে পারে সিসমোগ্রাফে ইতিহাস কাঁপছে ... বৃষ্টি ভেজা মিলিটারি জিপি ... নির্বিকার'। লিরিক্যাল বা গীতিময়তার দৃশ্যের সঙ্গে কত সহজে মিশিয়ে দেন তথ্যচিত্র।
আমের আঁটি ... পাখির হার্টবিটস ... তুমি জানো ... আমিও জানি ... (পৃ. ১৯)
'তুমি জানো' প্রথমে রেখেছেন আর লিডর দিয়ে তারপর বলেছেন 'আমিও জানি'
... যেন 'তুমি জানো' বলেই 'আমিও জানি'।
অনুপম শেষমেশ
একটা সুর ধরিয়ে দিতে
চেয়েছেন। মানেগুলো নিয়ে
মাথাব্যথার দরকার নেই। হারমনি
থেকে নিয়ে যেতে চেয়েছেন
মেলোডিতে। ভাস্কর চক্রবর্তীর জন্য
তাঁরই শৈলী মেনে স্তবক
আছে
(পৃ.
১৭,
শেষ স্তবক)।
আবার সোমনাথ
হোর-এর
শিল্পভাবনার প্রতি সম্মান জানিয়ে
তাঁর ভাস্কর্য নির্মাণ পদ্ধতি
জানিয়েছেন পৃ. ২০-এর শেষ
স্তবকে রিয়্যাল ও ভার্চুয়ালের
যাতায়াতের গতিপ্রকৃতি দেখাতে।
... কাগজের মণ্ড ... প্লাস্টারের ফলক ... ছাপ ... / উণ্ডস ... / ক্ষত ... লাল রঙে ... রক্তের মতো ...
শিল্পচেতনার প্রত্যেক
এলাকায় কবির অনায়াস যাতায়াত, এলাকাগুলিকে
পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত করে
কবিতায় পুনর্জন্ম দিতে তাঁর
কোনো অসুবিধা নেই। তিনি
সিঙ্গল ডিসিপ্লিন থিঙ্কার নন। ঘড়িতে সময় দেখতে হয়, ভোরের
পাখি সময়কে শ্রাব্য করে
তোলে। হারমনি থেকে
মেলোডিতে চলে গেলে সময়
গলে পড়ে।
যার নাম
অপরাজিতা, সেও কিন্তু নামকরণে হেরে
যায়। অনুপম মুখোপাধ্যায়
কবিতা ক্যাম্পাস। ৪৮/২, ভৈরব
দত্ত লেন, সালকিয়া, হাওড়া - ৭১১ ০০৬। প্রচ্ছদ : বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। ২০ টাকা।
No comments:
Post a Comment