1911 Illustrations by Edmund Dulac |
প্রিয় পাঠক, আমি যদি আজ আপনার সামনে
মণীন্দ্রবাবুর এই কবিতাটি স্টাডি করতে চাই?
ওঁর লেখা আমার অন্যতম প্রিয় কবিতা এটি।
ঝর্ণা
এই স্বচ্ছতোয়া ঝর্ণাটির নাম সুলেমানের চশমা।
বুড়ো দরজি সুলেমানের গায়ের চামড়া ছিল রিফু করা মখমলের মতো।
কিন্তু মুঘল জাফরির মতো তার পাঁজরার মধ্যে ধকধক করত হৃৎপিন্ড
যেন মেঘের ফাটলে সূর্য। ফুল চন্দন ধূপ দীপ তামার টাট ছাড়াই সে
শুধু শরীর আর মন দিয়ে যোগাযোগ করত ঈশ্বরের সঙ্গে।
প্রার্থনার সময় বুড়োর প্রত্যেক রোমকূপ থেকে অদৃশ্য আঁকশি বেরোয়,
সেই আঁকশি ধরে বাতাস যেন টেনে নিয়ে যেতে চায় বুড়োকে শূন্যে।
এই কবিতায় আমাদের মনস্বী পাঠক হয়ত জাদুবাস্তব খুঁজে
পাবেন। আমি অবিশ্যি খুঁজে পেয়েছি টাইম ট্রাভেল … সময়ভ্রমণ। এই কবিতায় একসঙ্গে মিথ এবং
সায়েন্স ফিকশন খেলা করছে। কবি যেতে চেয়েছেন অন্য সময়ে, এবং
তা আসলে এক অন্য স্থান বা বিদেশ। এর ফলেই সময় আর স্থানকে আলাদা করা যাচ্ছে না এই
কবিতায়। বরং বলি অন্য ডায়মেনশন। আমাদেরই সমান্তরাল কোনো ভুবন। কবি সময় এবং স্থানের
সঙ্গে এক কামকেলিতে রত হয়েছেন, সফল হয়েছেন। সেই সাফল্য
আমাকে, এক নগন্য কবিতালেখককে, লোভাতুর
করছে অনুরূপ এক রমণে। আমি উত্তেজিত বোধ করছি ওই সুলেমানের সঙ্গে দেখা করার জন্য,
তাকে তার মিথ থেকে আলাদা করে নিয়ে গায়ে হাত দেওয়ার জন্য। বলা যায়
স্নান করতে চাইছি সুলেমানের চশমায়, যেখানে আকাশের ছায়া
অবশ্যই অচিন্ত্য কিছু হবে।
এই কবিতাকে টেক্সট হিসেবে যখন এই ২০১৪-এ পড়ছি, আমার সময়ভ্রমণ
এমনিতেই শুরু হচ্ছে দেখছি। ধরা যাক এই ২০১৪-এ আমার বয়স ২২ । আমি এক মহানগরবাসী,
এনড্রয়েডখোর, ইংরেজি মাধ্যমের ছাত্র।
তথাকথিত লোকজীবনের সঙ্গে আমার কোনো প্রত্যক্ষ যোগ কোনোকালে নেই ধরা যাক। নিজের
বাড়িতে আমি আজ অবধি কয়লার উনুন দেখিনি, বঁটি দেখিনি,
কুলো দেখিনি, শিলনোড়া দেখিনি। এমনকি ধরে
নেওয়া যাক আমার কোনো বন্ধুর বাড়িতেও চিচিঙ্গের পোস্ত সহসা রান্না হয় না। বাংলা
কবিতার রসিক তাতে তো হতে বাধা নেই? বাংলা কবিতা আমি
লুকিয়ে চুরিয়ে পড়ি। কিন্তু এই কবিতাটি পড়তে গিয়ে আপাতত আমি বুঝতে পারছি না কাকে ‘আঁকশি’ বলে, আর কাকে বলে
‘তামার টাট’। তাতে রস কি বাড়ছে?
আমি ভাবছি এ এক অনাস্বাদিত পুরাতন। নাকি কমছে? আমি ভাবছি এ আমার চায়ের কাপ নয়। তাতে অন্যের কাপে চুমুক দেওয়ার নিষিদ্ধ
স্বাদ পাচ্ছি।
অথচ বুঝতেই পারছি না এই কবিতা আদৌ বঙ্গজ কবিতা নয়।
কলমিলতা আর ভাঁটশ্যাওড়ার বঙ্গজীবন এখানে নেই। এই কবিতায় এক ভিনদেশ বিরাজ করছে।
মরুভূমিতে ওয়েসিসের রেখাগুলো কাঁপছে। একটা অন্য সময় বিরাজ করছে। কোনো একাদশী
পিসেমশাই এই কবিতার পৃথিবীর খবর রাখেন না।
হ্যাঁ, মাননীয় পাঠক, এই কবিতা তথাকথিত
বাংলা কবিতাই নয়। এ এক আন্তর্জাতিক কবিতা। কোনো বঙ্গজ কল্পনায় রোমকূপ থেকে আঁকশি
বেরোয় না। সেটার জন্য সালভাদরসুলভ তীব্রতা লাগে। জিরাফকে পুড়িয়ে দেওয়া স্পেনীয়
তীব্রতা। আরব দেশের হল্কা।
আমি তাহলে সাহস পেলাম। হয়তো একটা কাজ করলাম। ‘ফুল চন্দন ধূপ দীপ
তামার টাট’ বাদ দিলাম। তার বদলে ভাবলাম কী-বোর্ড মাউস
মনিটর হার্ডডিস্ক টরেন্ট। ‘দরজি’-কে করে দিলাম ‘নেটিজেন’। কেমন দাঁড়াল ব্যাপারটা? কবিতাটা কি এর ফলে আরো
‘সমকালীন’ হল? হয়ত হল। কিন্তু ২০৭৫-এ গিয়ে কী হবে? তখন তো
আবার বিনির্মাণের প্রয়োজন হবে! তখন একটি ২২ বছরের ছেলে বুঝতে পারবে না ২০১৪-এ কোন
বস্তুটিকে ‘মাউস’ বলা হত। মাউস
তখন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কী-বোর্ডও হয়তো নেই। আমি এখন যদি বুঝতে না পারি ‘আঁকশি’ হল সেই বস্তু যার মাধ্যমে উচ্চতা থেকে
ফলকে পাড়া হয়, তখন সেই ছেলে বা মেয়েটি কি বুঝবে, কাকে বলত ল্যান্ড টেলিফোন থেকে নেওয়া ইন্টারনেট কানেকশন? কারেন্ট চলে গেলে ইউ পি এস কেমন টিঁ টিঁ করে সংকেত দিতে তাকে? সম্ভবত বুঝবে না। তখন যে কোনো আলাদা ইন্টারনেট কানেকশনের বা ইউ পি এসের
প্রয়োজন হবে না সেটা জুলে ভের্ণ বা আর্থার সি ক্লার্কের অনুরাগী না হয়েও বলে দেওয়া
যায়। ‘নেটিজেন’-এর ধারণা তখন
মানুষের দূর স্মৃতিতেই একমাত্র থাকবে। লোডশেডিং-এর ক্ষেত্রেও সেটাই আশা করা যায়,
অবিশ্যি যদি আমাদের লোকনীতির প্রগতি এরকমই না রয়ে যায়।
তাহলে কি এই ‘ঝর্ণা’ কবিতাটির
সম্পর্কে আমরা এই সিদ্ধান্তে আসব যে, এই কবিতায় রয়েছে এক
অন্তহীন সময়ভ্রমণ? যেকোনো বিনির্মাণের পরেও সেটি অফুরাণ রয়ে
যায়?
অবশ্যই তাই। এই কবিতা সরাসরি আমাকে মনে করিয়ে দেয়
স্ট্যানলি কিউব্রিকের ‘২০০১ : এ স্পেস ওডিসি’ সিনেমাটির শেষ
দৃশ্যটিকে। পাঠক কি সিনেমাটি দেখেছেন? যদি না দেখে থাকেন,
দেখুন, এবং এই কবিতাটি আরেকবার পড়ুন এবং
কাছাকাছি একটি সত্যবাদী আয়না রাখুন। সব আয়না যে সত্যি কথা বলে না, এটাও কি বলে দিতে হবে? আমার আয়না তো আজ অবধি
বলল না।
আমরা কি তাহলে ধরে নেবো যে, এই কবিতার কোনো
শব্দকেই প্রতিস্থাপিত করার জো কবি রাখেননি? সেটা কি আলাদা
করে বিচার করার উপায় আছে? কোনো কবির কোনো কবিতাতেই কি
থাকে? কেন এমন হয় না যে, কবিতার
একটা বিশেষ শব্দের বদলে পৃথিবীর যে কোনো শব্দই ব্যবহারযোগ্য? ধরে নেওয়া যাক, ‘ঝর্ণা’ কবিতাটিতে ‘বাতাস’ শব্দের
বদলে ‘হাওয়া’ কি ব্যবহার করা যেত?
বা ‘পবন’? বা ‘বায়ু’? এমনকি ‘আবহাওয়া’
বা ‘পরিবেশ’? বা
… ‘গ্রীষ্ম’? বা ‘শীত’? হতে কি পারতো? এবং
এই হতে পারা না পারার প্রশ্নে উপনীত হওয়ার অনধিকারে কেন আমরা পা রাখবো? একমাত্র ‘বাতাস’-ই
হতে পারতো। একটা শব্দ ১ হয়, ২ হয় না। নাহলে ২ বলে কিছু থাকত
কি? কিন্তু টেনে নিয়ে যেতে চায় বুড়োকে শূন্যে যদি হত টেনে
নিয়ে যেতে চায় বুড়োকে ০-এ? একই কি হত? বলতে কি পারি ‘শূন্য = ০’? তাহলে তো কবিতার শব্দরূপকে সংখ্যারূপেও আমরা নিয়ে আসতে পারি না। এই
কবিতায় একটা শব্দ থাকছে তার শুদ্ধতম অবস্থানে, কোনো
সন্দেহেই তার আসন টলছে না, সে বাড়ছে-কমছে না।
তাহলে এই কবিতার ‘ঈশ্বর’-এর কী
হবে? একজন নাস্তিক পাঠক এই কবিতায় কি স্বস্তিতে থাকবেন?
তিনি তো ঈশ্বরকে দেখে বেঁচে থাকছেন না, পাত্তাই
দিতে চান না মন্দির-মসজিদ-গীর্জার অধিনায়ককে! তাহলে সেই অমর, আকবর, বা অ্যান্টনি কি এই কবিতা থেকে পাঠক
হিসেবে মুখ ফিরিয়ে নেবেন? কেন নেবেন? তাহলে তো বিষ্ণুপুরের মন্দিরের কাজগুলো থেকেও তাঁদের মুখ ফিরিয়ে নিতে
হয়! ‘ঈশ্বর’ এখানে একটি শব্দ বৈ
তো কিছু নন! বা … এই সুযোগে একটু কথার খেলা খেলে নিই,
এই কবিতায় তো বটেই যে কোনো শব্দ হল ঈশ্বর। শব্দকে ব্রহ্ম বলব
কিনা পদার্থবিদরা ধীরে ধীরে আমাদের জানিয়ে দেবেন, কিন্তু
মায়ায় প্রবেশ তো ব্রহ্মকে করতেই হয়, এবং ধ্বনি হয়ে ওঠে
শব্দরূপী ঈশ্বর। সেই শব্দ ‘ঈশ্বর’ হতে পারে, ‘শয়তান’ হতে
পারে, ‘রোমকূপ’-ও হতে পারে।
শব্দের এই বহুরূপী স্বভাবকে যিনি স্বীকার করেন তিনি কবি, একমাত্র তিনিই কবি।
শব্দের বিয়ে তিনি দেওয়ার সাহস রাখেন, ডিভোর্সের ভয়ে
পিছিয়ে যান না, তারা ভবিষ্যতে সুখী হবে কিনা তাতে ভাবিত
হয়ে আড়াল খোঁজেন না অন্যের স্বীকৃত কবিতায়। এই শুদ্ধ অবস্থান তাঁদেরও অন্যদের
দ্বারা অনুকরণের উপায় রাখে না। একটি কবিতায় প্রবেশকারী সড়কপথ, সেখানে অবস্থিত সার্বজনিক নলকূপ, কবিতাটির সব্য
দ্বার, চৌকাঠ, বাতায়নবিধি,
বর্ণনির্বাচন, ব্রম্ভস্থান, মেজেনাইন ফ্লোর, যথাবিধি বৃক্ষরোপন, পাদুকাস্থান, ফুয়েল ট্রিটমেন্ট প্লান্ট …
এই সব কিছু নির্মাণ করেন কবি … কিন্তু
বাস্তুদেবতার নাম? বাস্তুদেবতার সঙ্গে কবির কোনো সংলাপ কি
হল? তিনি কি পাঠক? সমালোচক?
সম্পাদক? নাকি একটি কবিতার বাস্তুদেবতা
কবিরই এক অন্যতর সত্ত্বা? হলেও, অবিরলভাবে
নয়।
মণীন্দ্র গুপ্ত এমনই এক কবি। তিনি সেই বিরল কবিদের একজন। মণীন্দ্র
গুপ্ত লেখেন, কিন্তু সেই লেখার পাঠক হিসেবে তিনি সাব্যস্ত
করে রাখেন এক অন্যতর এবং বৃহত্তর মণীন্দ্র গুপ্তকে। সেই বৃহত্তর মণীন্দ্র তাঁর
কবিতায় সোনার তরীর মাঝিমশাই। জমাখরচের ইচ্ছা-অনিচ্ছার খাতা তিনিই দেখবেন চোখের
বাইরে। মূর্ত-বিমূর্তর বাইরে, বাণীসংকলনের বাইরে …
এবং হয়ত যেকোনো বৈপরীত্য এবং কোলাহলের উপশম ও সমন্বয়ে। এর ফলেই
মণীন্দ্র গুপ্ত সেই কবিদের একজন নন যাঁদের অনুকরণ নাহলে তাঁরা লুপ্ত হয়ে যান,
বরং তাঁর অনুকরণ যে অসম্ভব, এই কারণেই
তিনি চিরজীবি বলে মনে হয়।
অবিশ্যি এত বকবকের পরেও আমার সুলেমান দর্জি হওয়াটা হল
না।
কবিকে চিনতে পারি এই মূল্যায়নটিতে। কীভাবে মণীন্দ্র গুপ্ত অন্য ধারার কবি তার যথার্থ একটি রূপরেখা দিয়েছেন। গতানুগতিক পাঠকের কাছে হয়তো এটা বোধগম্য নাও হতে পারে। ধন্যবাদ লেখককে।
ReplyDelete