পৃথিবীর দুঃখ কোথায়
প্রতিফলিত হয়? মানুষের শরীরে একটি অংশ রয়েছে দুঃখের ক্যানভাসস্বরূপ। দুঃখ সেখানে দেখা
দেয়। মুখ খুব কম কথা নয়। পাঁচটি ইন্দ্রিয় মুখে বাস
করে। মুখ, তাই, সংবেদনশীলতার আধার। মুখ, তাই, একটি প্রকাশ্য ইতিহাস। সেই মুখ যদি
পাথরের মতো অভিব্যক্তিশূন্য হয়, তবে জীবন হয় একটি পাথরের ইতিহা্স, হয়ত
জ্যোৎস্নালোকিত কোনো মনোলিথিক স্ট্রাকচারের একটি খন্ডপ্রস্তর। সেই
মুখ যদি সারাজীবনের সবগুলো পায়ের ছাপ এবং পায়ের শব্দে মুখর হয়ে থাকে, তবে সেই মুখ
এক রৌদ্রালোকিত মেঘমন্ডিত আত্মজীবনী। আর, একজন মানুষের জীবনই তো তার পৃথিবী!
মানুষের জীবন তার মুখে প্রতিফলিত হয়। এবং ঠিক এতটা লেখার পরেই আমরা রেমব্রাঁ
হার্মেনসজুন ভ্যান রিন-কে মনে করতে পারি, চোখের সামনে ভেসে উঠতে পারে ঋত্বিক কুমার
ঘটকের মুখখানি। তাঁদের পৃথিবীর দুঃখকে তাঁরা কঠোর ও অপ্রতিহতভাবে নিজেদের মুখে
ধারণ করেছিলেন। আর, কে না জানে, দুঃখ এবং আনন্দকে কেউ আলাদা করতে পারেনা। তাদের
মধ্যে কোনো নো ম্যান’স ল্যান্ড নেই। সম্ভবত ঋত্বিক আর রেমব্রাঁর মধ্যেও কোনো
সীমান্তরক্ষীর প্রয়োজন নেই।
যদি ঋত্বিকের প্রথম সিনেমা ‘নাগরিক’ ১৯৫২-এ
রিলিজড হতে পারত, যদি সেই সুযোগ তাকে দেওয়া হত, ঋত্বিকের জীবনকাহিনি আলাদা হতে
পারত। ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসটাও একটু অন্য হতে পারত। এই ২০১৬-এ আমরা সকলেই এটা
মেনে নিতে পারি। এবং এটা গুগলের যুগ। আমরা সকলেই রেমব্রাঁ সম্পর্কে অবহিত, অথবা
সেটা হয়ে নিতে পারি। তর্কসাপেক্ষভাবে নেদারল্যান্ডের
সর্বকালের শ্রেষ্ঠ শিল্পী রেমব্রাঁ, তর্কসাপেক্ষভাবে হয়ত পৃথিবীর ছবিশিল্পের তিনি
সম্রাট। কিন্তু তাঁর জীবনকাহিনিটা প্রতিশ্রুতি থেকে জাগতিক ব্যর্থতায় গড়িয়ে যাওয়ার
ইতিহাস। অনেক মহৎ শিল্পীর মতোই নিজের আকাঙ্ক্ষাকে রেমব্রাঁ সিসিফাসের পাথরের মতো
বহন করেছেন, নির্বাহ করেছেন। রেমব্রাঁ আঁকলেন তাঁর জীবনের অন্যতম ছবি ‘দ্য নাইট
ওয়াচ’। এই ছবির ইতিবৃত্ত আমরা জানি। এই ছবিটিতে শিল্পীর বাস্তববোধ, সাহস এবং
অকৃত্রিমতা ছবিটির বায়নাদাররা গ্রহণ করতে পারলেন না, নিজেদের স্বরূপ এবং কুশ্রীতা
তাঁরা নিতে পারলেন না, ছবিটিকে প্রত্যাখ্যান করলেন। যেমন প্রায় চারটি শতাব্দী পরে,
অন্য মহাদেশে, অন্য এক দেশেও তাঁর দর্শকরা নিতে পারেননি ঋত্বিক কুমার ঘটকের বাস্তবতাকে।
ঋত্বিক আর কিছুই নন, তাঁর বাস্তবতার ধারণা ছাড়া। তাঁর সময় সম্পর্কে তাঁর ধারণা,
তাঁর দেশ সম্পর্কে তাঁর ধারণা, কম্যুনিস্ট ন্যায়নীতি সম্পর্কে, শ্রেণিসংগ্রাম
সম্পর্কে, লোকশিল্প সম্পর্কে, এন্টারটেনমেন্ট সম্পর্কে, এমনকি সিনেমা সম্পর্কে
তাঁর যে বাস্তববোধ, সেটাই ঋত্বিক। সমসাময়িকরা সেটা গ্রহণ করতে প্রস্তুত ছিলেন না,
এমনকি সঠিক যুক্তিতে তাঁকে বর্জন করতেও তাঁর সমসময় পারেনি। আজও পারছে না। আজও একটা
‘নাগরিক’ সমসাময়িক সিনেমা, কারন সমস্যাটা গুণ বদলায়নি, মাত্রাফের হয়েছে মাত্র, ওই
যুবক আজও হেঁটে বেড়ায় কলকাতার পথে, বহরমপুর-মেদিনীপুরের পথে। আজও আমরা শুধু তার
মুখ চিনি, আত্মা চিনিনা। আত্মাটায় ঋত্বিক কুমার ঘটকের অধিকার ছিল।
আত্মা। খুউউব গোলমেলে শব্দ। আছে বলেই অনেকে
স্বীকার করেন না। একটা গাড়ি যে এক মানুষের চেয়েও বেশি মানব হয়ে উঠতে পারে, প্রাণী
নয়- একদম মানব, একজন ড্রাইভারের জীবনে, পেট্রল আর রক্ত এক হয়ে যেতে পারে, ঢকঢক করে
জল খেতে পারে একটা শ্রান্ত মোটর ভেহিকল, সুবোধ ঘোষ অবশ্যই ভাবতে পেরেছিলেন, কিন্তু
সেই স্তর অবধি নয়, যেখানে ঋত্বিক আমাদের দেখান। আমরা বুঝতে পারি এই লোকটা আদতে
সাহিত্যের লোক, কিন্তু লিখিত ভাষার সীমাবদ্ধতাকে লাথি মেরে ক্যামেরায় এসেছেন। তাঁর
আলোর বোধ, আবার, রেমব্রাঁকে মনে করিয়ে দ্যায়। আলো- এক আশ্চর্য জিনিস এই মহাপৃথিবীর
বুকে। তার উদ্ভাসকে একমাত্র ঈশ্বর দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়- কখনো তিনি চিত্রের
ঈশ্বর, কখনো চলচ্চিত্রের। রেমব্রাঁর ছবিতে আলোর যে ভূমিকা ঋত্বিকের সিনেমায় সে সেই
একই আধ্যাত্মিক স্তর থেকে আসে, একই গভীর থেকে উৎসারিত হয়। ‘অযান্ত্রিক’ সিনেমার
শেষে যখন গাড়িটাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, যেন একটা যুগের ভারি ও অচল ধ্বংসস্তুপ, যেন
এক মূল্যবোধের ভগ্নাবশেষ, যেন সত্যিই সে জগদ্দল, ছালচামড়া ছাড়িয়ে বিক্রয়হেতু
ঝুলিয়ে দেওয়া নিহত এক ষাঁড়, তার টুকরোগুলোর কিছু কিছু দাম এখনও করুণভাবে রয়ে গেছে,
দেখতে পাই তার হেডলাইটে কোন এক অচিন আলোর ঝলক লেগে আছে, সেই আলো চিরন্তনের,
অবিনশ্বরতার। সেই আলোই আবার পাই ‘মেঘে ঢাকা তারা’-এ নীতার সেই অভাবনীয় গানের দৃশ্যে
যখন তার পশ্চাদপট উদ্ভাসিত হয়ে যায়, চাবুকের পর চাবুক আছড়ে পড়ে, বেড়ার ফাঁকফোকর
দিয়ে এসে পড়ে অপরিসীমের আলো- ওই বেড়াটিকে নাকি প্রথমে ঋত্বিক বার্ন করে দিতে
চেয়েছিলেন যাতে অপ্রতিহত আলো এসে পড়ে, কিন্তু পরে সিদ্ধান্ত বদল হয়।
খুব অকারণেই
হয়ত, ঋত্বিকের সিনেমার আলোর ব্যবহার দেখতে দেখতে তাঁকে রেমব্রাঁর করা ‘ক্রাইস্ট
হিলিং দ্য সিক’ নামক সেই অসামান্য এচিংটির সঙ্গে মিলিয়ে নিতে ইচ্ছে করে আমার। ঋত্বিক,
যেন ওই ছবির ক্রাইস্ট। যিশু আসলে তো ধর্মের লোক অতটা ছিলেন না যতটা ছিলেন
লোকনীতির। ধর্ম আর লোকনীতির বিভেদরেখাটা ঘুলিয়ে গিয়েই তাঁর ক্রাইসিস, তাঁর ত্রাণ।
ঠিক যেমন ঋত্বিক পুরোপুরি সিনেমার লোক হয়ে উঠতে পারেননা, লোকনীতির লোক হতেও
পারেননা, লোকনীতি আর সিনেমার সীমারেখা বারবার নিশ্চয়তা চায় তাঁর কাছে, কিন্তু
পায়না। সিনেমাগুলো ফ্লপ করে যায় অসংখ্য কথার জন্ম দিয়ে। কথাগুলো ঠিকভুলের বারোটা
বাজিয়ে দেয়। দেশি মদ গড়িয়ে নামে চিত্রপট থেকে- নেশা!!! শুধু মদে যদি নেশা হত, তবে
তো বোতলগুলো মাতাল হয়ে যেত! ব্যক্তিগত সত্যের নেশা থেকে একজন একরোখা শিল্পীকে কে
সরাতে পারে, কে হারাতে পারে!
একটি
কালোত্তীর্ণ কিন্তু ফ্লপ সিনেমাই যেমন একজন মহৎ চিত্রপরিচালকের কেরিয়ারের সর্বনাশ
করতে পারে, ঠিক যেমন করেছে বাস্টার কীটনের ক্ষেত্রে ‘দ্য জেনারেল’, গুরু দত্ত-র
জীবনে ‘কাগজ কে ফুল’, তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত ছবি ‘দ্য নাইট ওয়াচ’ কিন্তু রেমবাঁর
বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিল। রেমব্রাঁ আর সেলিব্রিটি ছিলেন না। আর, আমরা জানি, যে কোনো
সমাজ শুধু সেলিব্রিটিদের আর্থিক খেয়াল রাখে। দেনার দায়ে বিকিয়ে গেলেন তিনি। অবিচার,
ব্যর্থতা, ঋণ, দারিদ্র্য, সামাজিক প্রহসন, ব্যভিচারের আরোপ এবং একের পর এক তীব্র
শোক যখন রেমব্রাঁকে নরকের আগুনের মতো ঘিরে ধরেছে, সেই আগুনের মধ্যেও তাঁর দীপ্তি
আমাদের চোখ জুড়িয়ে দেয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে আমাদের ঋত্বিক ঘটককে খুঁজতে শুরু করি
রেমব্রাঁর মধ্যে। ঠিক যেন মহাবিশ্বে দুটো মহাপৃথিবী ওভারল্যাপ করছে। ‘কোমল
গান্ধার-এর অসমাপ্ত রেললাইন, ‘সুবর্ণরেখা’-র রক্তমাখা বঁটি, ‘তিতাস একটি নদীর
নাম’-এর শেষ দৃশ্যের অনন্ত বালকবেলা- আমরা দেখি ঋত্বিকের মুখে জ্বলে উঠছে বেমানান
কিন্তু দীপ্র বিড়ি, তাঁর পাকস্থলীকে পুড়িয়ে দিচ্ছে দেশি মদ, আর তাঁর হাসিতে আরো
বেশি নাছোড়বান্দা পাখনা মেলে স্বর্গ এসে বসছে। তিনি পুড়ছেন, কিন্তু তাঁর সঙ্গেই
বিশ্বব্রহ্মান্ড পুড়ছে তার সবটুকু দাহ্যতা চেয়ে।
ঋত্বিক তাঁর জীবন শুরু করেছিলেন অসীম
প্রতিশ্রুতির মধ্যে। সেটা যেভাবে নষ্ট করেছে তাঁর দেশকাল, আমরা জানি সেই অনুচিত
ইতিহাস। আমরা জানি দেশভাগ তাঁকে কী দিয়েছে, তাঁর কম্যুনিস্ট পার্টি তাঁকে কী
দিয়েছে, তাঁর মাতৃচেতনা তাঁকে কী দিয়েছে, সর্বোপরি তাঁর সিনেমা তাঁকে বেঁচে থাকতে
কী দিয়েছে। একটা পদ্মশ্রী সেই চাওয়া-পাওয়া হিসাবে কানাকড়ির মূল্যও বহন করেনা। এবং
সেই ইতিহাস আরো অনেকবার বলা হবে। আর সেই ইতিহাসের মধ্যে থাকবে ঋত্বিকের ভুল-ঠিক যুক্তিগুলো,
ভুল-ঠিক তর্কগুলো, এবং সেই গল্পগুলো যা থেকে একজন যোদ্ধা ধীরে ধীরে মিথে পরিণত হন,
সমকালীন দেবত্বে উত্তীর্ণ হন। ঋত্বিক আমাদের এই পরিসরের একজন দেবতা। তিনি তাঁর
সময়ে আমাদের পেয়েছেন কিনা বলতে পারিনা, কিন্তু আমরা যে তাঁকে আমাদের সময়ে কিছুটা
হলেও পেয়েছি, প্রয়োগ করার সুযোগটাও পেয়েছি, এটা আমাদের পরম পাওয়া। অবিশ্যি তাঁর
জীবন আমাদের অপরাধী করে দেয়। তাঁর ওই মুখ আমাদের মুখের উপরে তাঁরই চলচ্চিত্রের
বিজন ভট্টাচার্যের সেই চরিত্রটির মতো আঙুল তোলে, ‘I accuse!’ কিন্তু যদি
পালটা প্রশ্ন করি,‘কাকে?’ ... সেই মুখ লুকিয়ে পড়েনা, বরং ফুটে ওঠে এক আশ্চর্য
হাসি, সেই হাসিতে একটি শিশুর স্বর্গস্মৃতি আছে তার খিদের পাশাপাশি, যা তাঁর মুখে
‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’-এর কয়েকটা ফ্রেমে অনাবিল ও অবিনশ্বর হয়ে আছে।
ঋত্বিক
বিদ্রোহ করেছিলেন। এক আশ্চর্য বিদ্রোহ, যা কেবল একজন পাগল জিনিয়াসই করতে পারতেন,
করতে পারেন। আলোর হয়ে অন্ধকারের বিরুদ্ধে, রূপের হয়ে কুশ্রীতার
বিরুদ্ধে। ঋত্বিক পথভ্রষ্ট ছিলেন, অবশ্যই, কারন বাঁধা পথের পথিক তিনি ছিলেন না,
কোনো তত্ত্বের লাইব্রেরিতে তিনি মানুষের দুঃখকে ব্যাখ্যা করতে পারেননি, তাই তিনি
লাইব্রেরির লোকেদের কাছেও পুরোপুরি স্বস্তিকর ছিলেন না, আজও সম্ভবত নন। দুইবাংলার
একীকরণের তাঁর যে স্বপ্ন, তা তাঁর নিজস্ব বাস্তব, কিন্তু অন্যদের কাছে অবাস্তব,
হতেই পারে, আজ তা আরও দূরের মরীচিকা হয়ে উঠেছে। দুটো জার্মানি এক হয়ে যেতে পারত,
পেরেছে, কিন্তু দুটো বাংলাকে মেলাতে কোনো ঋত্বিক ঘটক নন, একমাত্র হয়ত বঙ্গোপসাগরই
পারে। একজন উত্তম কুমার যদি সেই একীকরণের কথা মুখ ফুটে বলতেন, সেটাকে চৈতালি রাতের
স্বপ্ন মনে হতে পারত, কারন উত্তম সেলিব্রিটি ছিলেন, এই সমাজে একমাত্র
সেলিব্রিটিদের স্বপ্নই মান্যতা পায়, ঋত্বিকের মতো এক শহুরে ভাঙা ব্যর্থ
ইন্টেলেকচ্যুয়ালের ক্ষেত্রে ওটা দিবাস্বপ্ন ছাড়া কিছু ছিলনা, আমাদের পোড়া সমাজ
তাঁর কথা বলার অধিকার সম্পর্কেই নিঃসংশয় হতে পারেনি। ঋত্বিকের
অদ্ভুত ছবিগুলো সিনেমা হলে রিলিজ করেছে, কিন্তু আমাদের সমাজ সেই হল ভরানোর প্রয়োজন
দ্যাখেনি। তখনই ‘মৌচাক’ বা ‘অমানুষ’ বাজার কাঁপিয়েছে। পাবলিকের সামনে সোজা অপশন
ছিল- ‘কেন চেয়ে আছো গো মা’ আর ‘বেশ করেছি প্রেম করেছি করবই তো’-র মধ্যে, সে বেছে
নিতে দ্বিধা করেনি। আজও করছে কি?
ঋত্বিক সেই
বিরল পুরুষ, যিনি নিজের ব্যর্থতাগুলোকে উদযাপন করে গ্যাছেন।
নিজের চলচ্চিত্র শিক্ষাকে চুরমার করে নিজের ব্যাকরণ গড়ে তুলেছেন। এখানে
আবার একবার রেমব্রাঁর প্রসঙ্গ তুলি। কিছু মনে করবেন না, আজ এই দুজনকে মিলিয়ে
দেওয়ার নেশায় পেয়েছে আমাকে। তাঁর সমসময়ে বসে ঋত্বিকের ব্যর্থতাগুলোই তাঁর সফলতা
ছিল, যেমন রেমব্রাঁর ছবিতে অন্ধকার থাকে আলোকে আরো বেশি আলো করে তোলার জন্য।
রেমব্রাঁ সবচেয়ে বেশি এঁকেছেন নিজেকে, নিজের মুখে ছবি। আত্মপ্রতিকৃতি আঁকার
ক্ষেত্রে একমাত্র ফ্রিডা কাহলো ছাড়া আর কেউ মনে হয় তাঁর কাছাকাছি নেই। প্রথম
যৌবনের সাফল্যে ডগমগ থেকে শুরু করে শেষ বয়সের তছনছ হয়ে যাওয়া নিজের মুখটি অবধি
প্রায় ৪০-৫০টি আত্মপ্রতিকৃতিতে ধরে রেখেছেন। ঋত্বিক ঘটকের যে কোনো সিনেমাতেই একটি
আত্মপ্রতিকৃতির আদল ও আবহ মিশে থাকে। নিজেকে এতখানি নিয়োগ করে আর কেউ সিনেমা বানিয়েছেন
কি এই দেশে? সম্ভবত না। শিল্প থেকে শিল্পী নিজেকে সরিয়ে রাখবেন, এমন নৈর্বক্তিক
ঠান্ডা ধারণা থেকেও মহৎ শিল্প রচিত হয়। কিন্তু আমাদের দেশে হাজার বছর ধরে যে শিল্প
প্রস্তুত হয়েছে, সেখানে শিল্পীকে আলাদা করে নিজের নাম লিখতে হয়না, তাঁর ব্যক্তিত্ব
এবং স্বভাব তাঁর শিল্পে তাঁর নাম লিখে দেয়। এলিয়েনেশনের ধারণাটা পাশ্চাত্য, আমাদের
দেশে ওটা খুব মানানসই নয়। এই দেশ নিজেকে জানার দেশ, নিজেকে উদযাপন করার ভূমি।
ঋত্বিক ঘটক সিনেমা নামক বিদেশি মাধ্যমটিতে দেশীয় শিল্পের উদ্বোধক, এবং এখনও অবধি
একমাত্র তর্কসাপেক্ষ দিশারী। তবে, আলাদা করে ‘আমি’ বলতে তাঁকে হয়না, তাঁর সিনেমাই
তাঁর ‘আমি’।
ঋত্বিকের
একটি চলচ্চিত্র তো যে কোনো আত্মপ্রতিকৃতির সাধারণ ধারণা থেকে বিশেষ পরিসরে গিয়ে
উপস্থিত হয়। সে আর ছবিমাত্র থাকেনা, চলচ্ছবিমাত্র থাকেনা, হয়ে ওঠে ছুটন্ত জ্বলন্ত
লিপিবদ্ধ জীবন। নিজের একটিমাত্র স্থিরসংকল্প জীবন, ও গলে-গলে পড়া যাপন। সে হল
‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’। প্রথম যৌবন থেকে শুরু
করে প্রৌঢ়ত্ব অবধি, স্বপ্ন থেকে শুরু করে স্বপ্নের ভাঙা টুকরোগুলো অবধি- সেখানে
একজন ঋত্বিক ঘটক, এমনকি, যখন একটি সিনেমার প্রতিটি চরিত্রই ঋত্বিক ঘটক।
সিনেমাটি
তার সমকালে প্রত্যাখ্যাত এক ক্যানভাস। লং, মিড, ক্লোজ শটের ভিতরে ও বাইরে, এদের
সীমারেখাগুলোকে তছনছ করে, যেন সরু-মোটা তুলিগুলোর ক্ষমতা ও শক্তির অনেক উপরে স্বয়ং
এক জীবন, যা ঝুঁকে পড়েছে তার আকাঙ্ক্ষার ভারে, কিন্তু নত নয়, অবনত নয়, স্পর্ধায়
সমুন্নত, সে বিনয় বোঝেনা, প্রেম বোঝে, যাতনার আর্তনাদ বোঝে, চেতনার শীৎকার বোঝে
মাটি আর আকাশের সীমারেখায় বেজে ওঠা।
এই লেখাটি এতোটাই উপর ও ভিতরে বসে লেখা যে খুব নিঁখুতভাবে, নিচু থেকে চাঁদের দাগগুলো দেখা গেল
ReplyDeleteআসলেই ঐ আত্মাটায় ঋত্বিকের অধিকার আছে।
ReplyDeleteখুব শক্তিশালী লেখা। পড়লাম। ভালো লাগলো।
ReplyDelete