আমার সচেতনতা যেন অতিচেতনার সমপরিমাণ হয়ে যায়
উভয় চেতনা যেন সমান কুশলী হয় সমান সক্ষম হয়ে যায়
দুই চেতনার মাঝের যোগাযোগ ব্যবস্হাটি যেন খুব স্বচ্ছলতা পায়
বিনয় মজুমদার ।। অঘ্রাণের অনুভূতিমালা
উভয় চেতনা যেন সমান কুশলী হয় সমান সক্ষম হয়ে যায়
দুই চেতনার মাঝের যোগাযোগ ব্যবস্হাটি যেন খুব স্বচ্ছলতা পায়
বিনয় মজুমদার ।। অঘ্রাণের অনুভূতিমালা
অনেক আমগাছের দেশ থেকে, যেখানে কিছু আকাশের গায়ে পড়ে গেছে নীল রবারের
থাবা, বারীন ঘোষাল নিজের আত্মপ্রতিকৃতি ভেঙে একটা দরজা খুলতে এসেছিলেন। কিছু জানালা তার থেকে স্পর্ধা পেয়ে খুলে ফেলেছিল নিজেদের। প্রস্ফূটনের একটা খেলা শুরু
হয়েছিল। বাংলা কবিতার যে ধারাটা নর্দমার মতো কালো আর অসুস্থ হয়ে পড়েছিল, সেটা থেকে
মুক্তি। কবিদের স্বাধীনতা। অবগাহনের। সন্তরণের। খুব সংক্ষেপে নতুন কবিতা বলতে আমি
বিংশ শতাব্দীর শেষ লগ্নের সেই খেলাটাকে বুঝি। দরজার চেয়ে জানালার দাম বুঝি কম? কম
কাঠ লাগে? তাই কি? আমি যদি নতুন কবিতার কোনো আকরগ্রন্থ রচনা করতাম, সেটা হত আশির
দশক থেকে প্রথম দশক অবধি ছুঁয়ে থেকে সামগ্রিক বাংলা কবিতার আলোচনা। হয়তো নাম দিতাম
‘নতুন কবিতা ও তৎকালীন কবিসমাজ’। কিন্তু ও-রকম গ্রন্থ রচনার ধৈর্য বা স্পর্ধা বা
বিনয় আমার নেই, কোনোদিন হবে বলে মনে করি না। তবে এটা ঠিক, নতুন কবিতার প্রতি
মনোভাব থেকে, এবং নতুন কবিতাকে কে কীভাবে গ্রহণ করল সেই থেকে, বাংলা কবিতার গত ৩০
বছরের আবহাওয়া অনেকটাই বোঝা যায়।
তার আগে প্রায় বছর দশেকের
উদ্যোগপর্ব থাকলেও, আমি নিজের কবিতা প্রকাশ করা শুরু করেছিলাম শূন্য দশকের
প্রারম্ভে। নতুন কবিতার সংস্পর্শে প্রকৃত অর্থে আসি ২০০৪ নাগাদ। তার আগে নতুন
কবিতা সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। কিন্তু কবিতার ব্যাপারে তার মধ্যেই আমার নিজের
একটা অবস্থান তৈরি হয়ে গিয়েছিল। প্রায় পনের বছরের হাঁটা-প্র্যাকটিস সেটা। আর
বদলাবে না নিজের ভঙ্গী। অবিশ্যি প্রথম থেকেই আমি নিজের কবিতাটা লিখতে চেয়েছি।
অন্যের কবিতা লেখার কোনো ইচ্ছে কোনোকালে হয়নি। কিন্তু অন্যের কবিতার প্রতি পিপাসা,
সে থেকে নিজেকে জীবনে ছাড়াতে পারিনি, ছাড়াতে চাইনা। ২০০৪ নাগাদ নতুন কবিতা আমাকে
অব্যর্থভাবে টানল। আমি তার ভেতরের লোক হলাম না। তার বাইরের লোক হওয়ারও প্রয়োজন মনে
করলাম না। তার রসিয়া হয়ে গেলাম।
বারীনের সেনাপতিত্বে নতুন কবিতার যারা মহারথী,
স্বপন-রঞ্জন-প্রণব-ধীমান, তাঁরা আমার প্রজন্মের মানুষ ছিলেন না। তাঁরা আমার
বাপ-কাকার বয়সী। তাঁদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা কৌতূহল আর আগ্রহ ছাড়া কিছু দেওয়ার থাকে
না। পাঠক হতে পারি, আস্বাদক হতে পারি। মাঠে নেমে খেলার মধ্যে কোনো জেনারেশন গ্যাপ
মানায় না। আমার দশ বছর পরে যে তরুণ কবিতা লিখছে, সে কিন্তু আমার কবিতাটা লিখছে না।
প্রাসঙ্গিকতা যাই হোক, সে অন্য কবিতা লিখছে। এখনও কয়েক শতাব্দী ওঁদের কবিতা পড়া
হবে। এই শতাব্দীর কবিতার ওঁরা অহংকার। কিন্তু আমার সাপেক্ষে ওঁরা একটা অন্য
শতাব্দীর মানুষ। বিংশ শতাব্দীর। ওঁদের কবিতাও বিংশ শতাব্দীর। ওঁরা এই সময়ের কবিতাই
লিখছেন, কিন্তু সেই লেখা যদি ২০১০-এর পরে লিখতে আসা কবিকে তাজাভাবে হারিয়ে দেয়,
স্টাইলে পিছিয়ে দেয়, সেটা হোলে বুঝতে হবে বাংলা কবিতায় নতুন কবিতার পরে আর জেনেটিক
চেঞ্জ কিছুই ঘটেনি। তাহলে নতুন কবিতা আর স্বপ্ন থাকবে না, একটা বাঁধ হয়ে যাবে,
একটা অটল সীমান্ত, যা নদীকে আর এগোতে দেয়নি। আমি নতুন কবিতার কবিদের কবিতা পড়ে,
তাঁদের স্টাইল ও সিগনেচার থেকে নিজেকে মুক্ত রাখার চেষ্টাই করছিলাম। তাছাড়া ১৯৭৯-র
১৭ই ফেব্রুয়ারিতে জাত আমি, আমার যৌবন নতুন শতাব্দীর। আমার স্মৃতি এবং অভিজ্ঞতাগুলো নতুন কবিতায় নিজেকে প্রকাশ করতে পারত
না, করবেই বা কেন! তাঁদের সময়ের প্রচলিত ধারা এবং সেই ধারা থেকে মুক্তির তাগিদ
আমার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার ছিল।
তাই কোনোদিন নতুন কবিতা
লেখার চেষ্টাই করিনি। কিন্তু ওঁদের সময়ে ওঁরা অন্যরকম লেখার লড়াইটা যে চালিয়েছিলেন,
যে ত্যাগগুলো স্বীকার করেছিলেন, তার সুফল আমি নিজের রাস্তা তৈরি করতে গিয়ে অবশ্যই
পেয়েছি। আমার সময়ে অন্যরকম কাজ করার সাহসটা আর দুঃসাহস ছিল না। রিস্ক ছিল। কিন্তু
লেখার জায়গা পাওয়া দুঃসাধ্য ছিল না। ‘নতুন কবিতা’ পত্রিকায় আমার প্রচুর লেখা ছাপা
হয়েছে, ওঁদের প্রকাশনা থেকে আমার বই বেরিয়েছে, ওঁরা কোনোদিনই আমাকে কোনো ছাঁচে
টানেননি। কোনো ছাঁচ ছিলও না। আলাদা করে স্বপন বা রঞ্জন বা ধীমানকে অনুকরণ করা যেত,
যেমন অনেকেই করেছে। এখানে এই ‘আমি’-টাকে আপনারা আমার বাইরেও দেখতে পারেন। ঠিক
যেভাবে কোনদিন সর্বত্র পূজিত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বা জয় গোস্বামীর মতো লিখতে চাইনি,
অবহেলিত বারীন-স্বপন-রঞ্জন-প্রণব-ধীমানের মতোও লিখতে চাইনি, ওঁরা যেটা করেছেন আমি
সেটা থেকে অন্য কিছুই করতে চেয়েছিলাম পরিচয়ের একেবারে গোড়া থেকে। ওঁরা বাধা দেননি। অপরিসীম সাহায্যই করেছেন। বারীন ঘোষাল ২০০৪-এ ‘কৌরব
৯৮’-এ আমার একগুচ্ছ কবিতা ছেপেছিলেন, সেগুলো নতুন কবিতা ছিল না। উনি আমার অনেক
বইয়ের আলোচনা করেছেন, সেগুলোর একটাও নতুন কবিতাকে রেফার করে না। এমনকি আমার ‘অনুপম
% মানুষরা’-র ভূমিকা উনি লিখেছেন, সেটাতেও নতুন কবিতার কোনো গুণ ছিল না। আমার
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় উনি বাংলা কবিতার সিংহহৃদয় একজন মানুষ। আজ এরকম মানুষ খুবই বিরল। এবং মানুষ কোনো
হিসেবে আঁটে না, সেটা তার নিজের হলেও।
ধীমান-স্বপন-রঞ্জন-প্রণব- এই নামগুলো এক শ্বাসে বলে গেলাম। উচিত হোল না। এই প্রতিটা নাম বাংলা
কবিতার একেকটা ভূখন্ড। তাদের মধ্যে ভূপ্রকৃতির মিল ততটাই যতটা মরিশাসের সঙ্গে
আবুধাবির। এঁরা সবাই নতুন কবিতা লিখেছেন। কিন্তু কেউ কারও
মতো করে নয়। এঁদের কবিতার পৃথিবীগুলো একেবারেই আলাদা-আলাদা। এমনকি বারীনের
কবিতাভাবনা যেমন এঁদের প্রাণীত করেছে, এঁদের কবিতার বহু
গুণ বারীনের কবিতাতেও যাতায়াত করেছে। বারীন স্বয়ং কখনও স্বপন রায়, কখনও রঞ্জন
মৈত্র, কখনও ধীমান চক্রবর্তী, কখনও প্রণব পালের দ্বারা প্রভাবিত ও আক্রান্ত। প্রভা ব্যাপারটা অবিশ্যি এমনই। ক্রান্তিকারীর
লক্ষণটা এমনই। কাছের মানুষকে সে উজ্জ্বল করেই। বারীন নিজেই এঁদের কবিতা থেকে
পর্যাপ্ত গুণ এবং দিশা আহরণ করেছেন। প্রায় এক ব্লটিং পেপারের মতোই বারীন তাঁর সঙ্গীদের
কবিতা থেকে নতুনের এবং সম্ভাবনার সবটুকু দিশা শুষে নিতে চেয়েছিলেন। এ আমার ধারণা।
ভুল হতেই পারে। যোগ্যতর আলোচক এ-ব্যাপারে মনোযোগ দিতে পারেন।
বললাম কোনোদিন আমি নতুন
কবিতা লিখতে চাইনি। বললাম এই ‘আমি’ আমি ছাড়া যে কোনো কবিই হতে পারে। আসলে জেনারেশন
গ্যাপের কথা। কবিতায় প্রজন্ম একটা বিরাট ফ্যাক্টর। কবিতার ক্ষেত্রে প্যাসিভ
স্থানের উপরে সময় তার ভাষার চিহ্নগুলো বদলে বদলে চলে। সেটাই তার সেক্স, তার মৈথুন,
তার কেলি, তার বীজক্ষেত। এটাও বলা উচিত, আমি যে সময় লিখতে এসেছিলাম, নতুন
কবিতার কবিরা তাঁদের অনেক কাজ করে ফেলেছেন, অনেক কথাই বলে ফেলেছেন তাঁদের নিজ-নিজ
কবিতার সম্পর্কে। সমাজ খবর না রাখলেও, ওঁরা সেই সময়ের কবিতার মেজর পোয়েট। নতুন
কবিতা সেই ২০০৪ সালে এসে বাংলা কবিতার একটি প্রায়-ঘটে-যাওয়া রূপ হিসেবে আমার চোখে
পড়েছিল। আমার সমবয়সী কিছু কবির চোখে সে তখনও ঘটমান বর্তমান ছিল। কিন্তু আমার মনে
হয়েছিল, সেই সময়ের কবিতায় জয় গোস্বামী এবং নতুন কবিতা, উভয়ের প্রভাবকেই এড়িয়ে
যাওয়া মঙ্গলজনক। নিজের কন্ঠস্বরের প্রতিই আমার টান ছিল, হাঁকপাঁক ছিল। নিজের
সিনট্যাক্স চাইছিলাম, সেমানটিক্স খুঁজছিলাম। আমি নতুন কবিতা পড়তে চেয়েছিলাম, তার
গুণগুলো বুঝতে চেয়েছিলাম, ওঁদের সিদ্ধান্ত থেকে জন্ম নেওয়া বারণগুলোকে অস্বীকার
করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু নতুন কবিতা লিখতে চাইনি, তাই ও কথা বললাম।
নতুন কবিতার গুণগুলোর তাহলে কী হবে? বিগত শতকের আশির দশকের এই কবিরা
যখন নতুন কবিতা নামক ভাবনার সূত্রপাত করেছিলেন, প্রচলিত কবিতা থেকে সরে আসার একটা
তাগিদ তাঁদের মধ্যে অবশ্যম্ভাবী ছিল। তখনকার সো কলড মূলধারার কবিতা যে চিহ্নগুলোকে
কবিতার কৌলীন্যের প্রমাণ হিসেবে নির্ধারণ করেছিল, এঁরা সেগুলোকে বর্জনের মাধ্যমে
নিজেদের কবিতার শরীর তথা প্রতিমাকে তার অঙ্গসুষমা দিয়েছিলেন, চক্ষুদান করেছিলেন।
ওঁরা লাবণ্যময় কবিতাই লিখলেন, কিন্তু ছন্দকে অস্বীকার করলেন, সেই সঙ্গে
অন্ত্যমিলকেও (অবিশ্যি প্রণব পাল পরে ছন্দে এবং অন্ত্যমিলে কবিতা লিখেছেন।)। অথচ ‘দেশে’ এবং দেশে ও-দুটোই কবিতার সামাজিক সাফল্যের চরম শর্ত ছিল।
ওঁরা রিস্কটা নিলেন। সর্বোপরি ওঁরা জীবনান্দীয় পরিবেশকে নষ্ট করতে চাইলেন।
জীবনানন্দ তাঁর সময়ে ব্রাত্য ছিলেন। কিন্তু
বিশের দশকের শেষের দিকে তিনি এক ফ্যাশন আইকনে পর্যবসিত হয়েছিলেন। বিশের দশক বিষের দশক হতে চাইছিল। এঁরা ওই কৃত্রিম নাগরিক অবক্ষয়ী
বিষাদমগ্নতাকে আঘাত করলেন। লিরিকের পরে লিরিক লিখলেন, কিন্তু অলঙ্কারের সচেতন
প্রয়োগ এড়িয়ে গেলেন, হাততালির জন্য যেটা প্রয়োগ করা হত, অনিবার্য অলঙ্কারগুলো
ওঁদের কবিতায় আসার জন্য ওঁদের অমুমতি চায়নি। কবিতায়
‘মানে’-র একটিমাত্র রেখাকে ভেঙে ফেললেন।
অবশ্যই এ এক অন্তর্ঘাত ছিল, এই কবিরা হয়ে উঠেছিলেন কবিতার রাজ্যে
একেকজন মানববোমা। ক্ষুধা নয়, তাঁদের বিস্ফোরক ছিল পিপাসা। অবিশ্যি হাংরি-শ্রুতি-ধ্বংসকালীনের
মতো কোনো সামাজিক লক্ষ্য ছিল না। এ ছিল কিছু কবির মিলিত সিদ্ধান্ত, সেই
সিদ্ধান্তগুলো শুধু কবিতাকেই রেফার করেছিল, সমাজকে নয়, পাঠকের মনঃস্তত্ত্বকেও নয়।
এ ছিল শুধুই কবির ব্যাপার। ফলে বৃহত্তর সামাজিক পরিসরে তার কোনো ছাপ পড়েনি। সমাজের
এ ব্যাপারে একমাত্র প্যাসিভ ছাড়া কোনো ভূমিকা ছিল না সম্ভবত। নতুন কবিতা কোনো
আন্দোলন ছিল না, হাংরি-শ্রুতি-ধ্বংসকালীনের সঙ্গে তার এই তফাৎ। সে ছিল এক নিঃশব্দ
বিপ্লব। সুবর্ণরেখার পাশে চ্যে গ্যেভারার ক্যাম্প। কিন্তু বাঙালি মানসে তা
সীমাবদ্ধ। প্রায় এক কোটারি লিটারেচার। কোনো ভালগারিটির জায়গা নেই। গামছা বা গাড়ু
নেই। পান্তাভাতে কাঁচালংকা নেই। এলিটিস্ট বললেও ভুল বলা হয়না।
সামাজিক জীবনের বাইরে দ্বিতীয় এক জীবন- কবিজীবন চেয়েছিলেন এই কবিরা। নতুন
কবিতার কবিরা বৃহত্তর জনসংযোগের দিকে তাকাননি। তাকালে যে ফল হত এমন নয়। এটা অশিক্ষিত
জনসাধারণের পণ্ডিতম্মন্যতার দেশ। এই সমাজের শিক্ষা শুরু হয় আলফাবেটে, আর শেষ হয়
চাকরির হাজিরা খাতায়, মাঝখানে থাকে নোটবইয়ের সাম্রাজ্য। সাহিত্যশিক্ষার অবস্থা আরো
দুঃসহ। বাংলায় এম.এ. পাস করা লোকেরা এখানে সাহিত্যের ক্ষেত্রে সবচেয়ে দরিদ্র। এই
প্রেত হয়ে থাকা বাঙালি মগ্নচেতনের সুররিয়ালকেই হজম করতে পারে না, অতিচেতনার (ওটা
কি বারীনের কয়েনেজ? গবেষক বলবেন।) মূল্য কী দেবে? হয়তো জনসাধারণের চেয়ে নিজেদের
কবিতার প্রতি দায়বদ্ধ থেকে এই কবিরা সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছিলেন। কিন্তু এর ফলে
বাংলা কবিতার গড্ডলিকা যেমন কে তেমন বয়ে গেছে, তার কোনো অসুবিধা হয়নি নিজের
পঙ্কিলতাকেই ঐতিহ্য হিসেবে চালিয়ে দিতে।
বারীন ঘোষাল সারা পশ্চিমবঙ্গে ঘুরে বেরিয়েছেন, নতুন-নতুন কবির
সন্ধানে। কিন্তু, তিনি কবির খোঁজ করেছেন যারা নতুন কবিতায় যুক্ত হবে, সামান্য পাঠকের
প্রতি তিনি নিরাসক্ত ছিলেন, গামছা পরে স্নান করতে যাওয়া বা তাবিজ-মাদুলি পরা বা
কব্জিতে সুতো বাঁধা পাঠক তিনি চাননি, যদি আমার খুব ভুল না হয়। বারীন ঘোষাল
মার্সিডিজ আর বাজাজের স্কুটার এবং রেড ওয়াইন আর হাঁড়িয়ার মধ্যে অপ্রস্তুত
মধ্যবিত্ত বাঙালির বাস্তবতাকে অস্বীকারই করেছিলেন। এর ফলে তাঁর অবস্থান অভিজাত
হয়েছে কিনা বলতে পারি না, সম্ভ্রান্ত অবশ্যই হয়েছে। অথচ তিনি প্রতিষ্ঠানকেও খারিজ
করেননি। বিবিধ কবিতা উৎসবে এবং মেলায় কবিতা পড়তে গেছেন এক সাধারণ কবির মতো,
আমন্ত্রণে কোনো সম্রাটের মহিমা ছাড়াই। ওটাও তাঁকে মানায়নি। ওগুলো তাঁর ফিরিয়ে
দেওয়া সঙ্গত ছিল। সরকারি লিটিল ম্যাগ মেলায় কবিতা কেন পড়বেন একজন ক্রান্তিকারী
কবি? এগুলো তাঁর আত্মবিরোধ।
কবির সংখ্যা এমনিতেই কম ছিল না। প্রয়োজন ছিল পাঠকের সংখ্যাহীনতার।
পাঠক সেই পড়ে থেকেছে ‘দেশ’-এর পাতায়। পাঠক এসবের খবরই পায়নি। বারীন ঘোষাল উত্তরবঙ্গ
থেকে শুরু করে গড়বেতা অবধি কবির পরে কবি যুক্ত করেছেন নতুন কবিতায়। বইমেলার স্টলেও তাঁকে ঘিরে কবিরা ভিড় করেছে,
কবিতা লিখতে চাওয়া লোকেরাই ভিড় করেছে। শুধু যেন একটা পতাকা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার
ব্যাপার। সংঘবদ্ধতার দায়। হ্যাঁ, কবিই পেয়েছেন, পাঠক পাননি। নব্বই দশকের
কবিরা এসেছেন। অতনু বন্দ্যোপাধ্যায়কে তো সবচেয়ে একনিষ্ঠ বলা চলে। প্রদীপ
চক্রবর্তী, আর্যনীল মুখোপাধ্যায়, রাজর্ষি চট্টোপাধ্যায়... এই নামগুলোকেও নতুন
কবিতার সঙ্গে যোগ আর বিয়োগের মাধ্যমেই ব্যাখ্যা করতে হয়। শূন্য দশকের অমিতাভ
প্রহরাজ, ইন্দ্রনীল ঘোষ, দেবাঞ্জন দাস, অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়, সোমতীর্থ নন্দী,
অস্তনির্জন দত্ত, নবেন্দু বিকাশ রায়... এমনকি এই প্রথম দশকের দেবাদৃতা বসু, ভাস্বতী
গোস্বামী, বা রাজর্ষি মজুমদার... অর্থাৎ একের পর এক নাম নতুন কবিতার ধারায় নেমে
অথবা ধারা থেকে উঠে নিজ পরিচয়ে বাংলা কবিতায় থাকতে চেয়েছে, আজও চাইছে, যদিও আজও,
এই সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং-এর যুগেও, নতুন কবিতার কোন বৃহত্তর সামাজিক গুরুত্ব তৈরি
হয়নি। এ এক অভাবনীয় জয়, অবশ্যই। নতুন কবিতা জিতে গেছে। এটাই হয়তো ঠিক,
আমাদের এখানে কবিরাই পাঠক। কবিরাই সংখ্যাগুরু। নতুন কবিতা হেরে থাকলেই ভালো থাকত।
কারন সে মূর্খ যেমন নয়, সামাজিকও নয়। পাঠকের ভাঁড়ার তার ফাঁকাই রয়ে গেছে।
এবং ধারা। বহমানতা থাকলেই ধারা থাকবে। অস্বীকার করার উপায় নেই। ধারা
থাকলেই ধারামুক্তিও থাকবে। আজ এটাই মনে হয়, সামাজিক বা সাংস্কৃতিক কোনো গুরুত্ব
ছাড়াই নতুন কবিতা এই মুহূর্তে বাংলা কবিতার অঘোষিত অন্যতম স্ট্রিম। বাংলা কবিতার
আনক্যাননাইজড একটা ধারা এখানে। আজকের যে তরুণ কবিরা
জয় গোস্বামী বা সুবোধ সরকারের বদলে ধীমান-স্বপন-রঞ্জনের যুগান্তকারী কবিতার অননুকরণীয়
সিনট্যাক্স-ডিকশন আর বারীনের প্রবন্ধের (আমার ধারণা নতুন কবিতায় নতুনতর ও নতুনতম
যে নামগুলো যুক্ত হচ্ছে, তাদের কাছে বারীন ঘোষালের প্রবন্ধর গুরুত্বই বেশি, কবিতার
নয়।) বইগুলোকেই নিজেদের কবিতাচর্চার কম্পাস হিসেবে ব্যবহার করছেন, তাঁরা
অপেক্ষাকৃত বুদ্ধিমান এবং দুনিয়াদারিটা সত্যি করে বোঝেন বলে মনে হয়। এঁদের সংখ্যাটা কম নয়। এবং নতুন কবিতার সংঘবদ্ধতা অনেক ভাঙচুরের পরেও
আজও ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে। সেটা পাঠক থেকে পাঠকে সঞ্চারিত ধারা নয়, একের পর এক
কবির আশ্রয় নেওয়ার ধারা। এর মধ্যে কিছু কবির শখের বিদ্রোহও আছে। তাঁদের
বারীন-বিরোধীতা আসলে বারীন-অবসেশনের একটা রূপ। আর, ধারা কিন্তু অপরিসীম নয়, যতক্ষণ
না সে বাঁধ ভাঙছে, বিধ্বংসী হচ্ছে, এবং তারপর নতুন পলির উর্বরতার খেলা।
কিন্তু, মনে হয়, বারীন ঘোষাল এখন নতুনতম প্রজন্মেও জারি থাকা এই ধারার
ব্যাপারটা এনজয় করছেন, বজায় রাখতে চাইছেন। বাংলা কবিতার যে কোনো নতুনকেই আজ তিনি
সন্দেহের চোখে দেখেন, যদি তা তাঁর গদ্যের বইগুলোকে রেফার না করে, স্বয়ং তাঁকে
যুক্ত না করে। আমি ফেসবুকে ২০১৪-এ প্রথম যেদিন পুনরাধুনিকের কথা বলেছিলাম, বারীন
তীব্রভাবে রি-অ্যাক্ট করেছিলেন- ‘ক্যান্সারাস গ্রোথ হচ্ছে’। তখনও উনি জানতেনই না
পুনরাধুনিক সম্পর্কে আমি কী বলতে চাই। খুবই কষ্টের সঙ্গে আমার মনে হয়েছিল উনি
ভেবেছেন আমি নতুন কবিতাকে আক্রমণ করার জন্যই পুনরাধুনিকের অবতারণা করছি, কথা বলছি।
আমি পুনরাধুনিককে কোনো ম্যানিফেস্টো বা কবিতাতত্ত্ব নয়, একটা সামাজিক মনোভাব
হিসেবে গড়ে তুলেছি। কবি একা হবে। সে সঙ্গে থাকবে, সঙ্ঘে নয়। পত্রিকা তার লেখা থেকে
পরিচিতি নেবে, সে কোনো পত্রিকার নামে পরিচিত হবে না। সে সমাজকে তুচ্ছ করবে না।
সমাজ- কবির অন্তর্গত সমাজ- যা নিয়ে নতুন কবিতার কোনো আগ্রহ কোনোকালেই নেই। কিন্তু শুরুতেই বারীন ঘোষালের এই মানসিকতা আমাকে স্তম্ভিত ও ব্যথিতই
করেছিল। এ ওঁকে মানায় কি! এটা কিন্তু শুধু ধারার নয়, একটা ধারাকে বজায় রাখার
প্রবণতাকে দর্শায়। বারীন আজ তাঁর থেমে থাকাকেও কি এনজয় করছেন? আজকাল তাঁর কবিতাও
আর সেই চরম বিস্ময় জাগায় না। একটা কমফোর্ট জোনে তিনি নিয়ে চলে গেছেন নিজেকে। নিজের
বাইরে বেরোচ্ছেন কম। কমবয়সী কারও মধ্যে নিজের লেখার বা ভাবনার ছায়া দেখতে পেলেই
উল্লসিত হচ্ছেন। সেটা কি তাঁর বয়সের দাবী? ওঁর ফিউডাল প্রতিক্রিয়ায় আমার মনে
হয়েছিল বাংলা কবিতার অন্য মহাভারতে উনি একজন দেবব্রত ভীষ্ম, আর আমি বুঝি বিগড়ে
যাওয়া উচ্চাশার ফলে ব্রাত্য হয়ে থাকা সূতপুত্র কর্ণ।
ঘটনা হল, শেষ অবধি নতুন কবিতার সম্ভবত আর কবির দরকার নেই, অনুসরণকারীর
দরকার নেই। এবার পাঠক দরকার। যারা সুদূরের যাত্রী, কবিতা লেখে না, কিন্তু
কবিতাপ্রাণ, এমন পাঠক। সেই পাঠক যে আজ শ্রীজাততে মজে আছে, জয় গোস্বামীতেই মগ্ন হয়ে
আছে, রঞ্জন-স্বপনের নামই জানে না। কবি সংগ্রহের পরিবর্তে, সদ্য লিখতে আসা
তরুণ কবিদের নতুন কবিতার মন্ত্রে ব্যাপ্তাইজড করার পরিবর্তে, সে-দিকেই এঁরা নজর
দিলে ভালো করবেন। কবিরা কবিদের অমরত্ব দেয় না। পেট্রোল বা ফলিডল, কিছুই হয়তো দেয় না। একজন লেখকের একমাত্র গুরুত্ব সামাজিক গুরুত্ব। ঐতিহাসিক গুরুত্ব সেটা
থেকেই নিরূপিত হয়। সেই সমাজ সমকালীন না হোক, সেই ইতিহাস অতীতের হোক, বা ভবিষ্যতের।
অগ্রজ কবির মাংস খেয়ে বেঁচে থাকা বা পাঁচ-দশ-বারো বছর লিখে ফুরিয়ে যাওয়া অস্ত্রশস্ত্রহীন
কবিযশোপ্রার্থীরা নতুন কবিতা কেন, কোনোকিছুতেই কিছু যোগ করতে পারে না। শেষ কথা বলে
পাঠক। সুদূরের পাঠক। অদৃশ্য পাঠক। যার নাম পিপাসা মল্লিক বা তৃষা বন্দ্যোপাধ্যায়
বা আকাঙ্ক্ষা সামন্ত। নামে কী আসে-যায় বলুন তো?
১। আমি
২০০০ থেকে ২০০৬ অবধি নতুন কবিতা সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানতাম না। সেই সময়টায় কবি
অমিতাভ মৈত্র ঘাটালে এস ডি ও হয়ে এসেছিলেন। আমি ওঁর সঙ্গে নিয়মিত আড্ডা দিতাম। সেই
মুহূর্তে আমি ‘কবিতা পাক্ষিক’-এ কবিতা লিখতাম। পোস্টমডার্ন কবিতা লিখতাম না। নিজের
লেখাটাই লিখতাম। ২০০৬-এ ‘কবিতা পাক্ষিক’ থেকে আমার
প্রথম বই করি- ‘রোদ ওঠার আগে’। সেইসঙ্গে ‘কৃত্তিবাস’, ‘দেশ’ ইত্যাদি পত্রিকাতেও
লিখতাম। অমিতাভ মৈত্র আমাকে ২০০৪-এর শেষের দিকে ‘কৌরব’ পত্রিকার নাম বলেন। আমি কয়েকটা কবিতা পাঠাই।
‘কৌরব’-এর ৯৮তম সংখ্যায় সঙ্গে সঙ্গেই প্রকাশিত হয়। সেই প্রথম বারীন ঘোষালের নাম
শুনি। তখনও আমি স্বপন রায়, রঞ্জন মৈত্রদের নাম জানতাম না। বারীন ঘোষাল ওই সময়ে
একবার ঘাটালে এসেছিলেন অমিতাভ মৈত্রর অতিথি হয়ে। আমাকে দেখা করতে বলেছিলেন। এই
গিয়ে দেখা করার ব্যাপারে আমার ইগো কাজ করেছিল। আমি যাইনি। বলেছিলাম কাজে আটকে
গেছি। এটুকু অহং আমার মধ্যে আজীবন থাক, অনুমতি করুন।
২।
অমিতাভ মৈত্রর কাছেই ‘কবিতা ক্যাম্পাস’ পত্রিকা দেখি। তখন সেই পত্রিকা চালাচ্ছেন
অলোক বিশ্বাস। দেখতে পাই ‘কবিতা ক্যাম্পাস’ অন্যরকম লেখালেখি প্রকাশ করে। আমি
চিরকালই অন্য পথের পথিকদের দ্বারা আকৃষ্ট হই। ওই পত্রিকার প্রতিও হলাম। অলোক
বিশ্বাসকে ফোন করলাম। গাঢ় সম্পর্ক গড়ে উঠল। আজও বজায় আছে। অলোক বিশ্বাস একাধিকবার
আমার বাড়িতে এলেন। আমি ২০০৭ সালে ‘কবিতা ক্যাম্পাস’ থেকে ‘যার নাম অপরাজিতা, সেও
কিন্তু নামকরণে হেরে যায়’ প্রকাশ করলাম। বইটি তার সমকালীন কবিতা ভাবনার বাইরের
একটা বই ছিল। শূন্য দশকের কিছু কবি আজও ওই বই দ্বারা প্রভাবিত, নিজেই বলছি, খোঁজ
নিয়ে দেখুন। বইটি আমি বেশ কয়েকজনকে পাঠাই। তাঁদের মধ্যে বারীন ঘোষাল ছিলেন। উনি
একটি পোস্টকার্ডে বইটি ওঁর খুব খারাপ লেগেছে জানান। এর কারণ পরে শুনতে পাই- বইটি
‘কবিতা ক্যাম্পাস’ থেকে প্রকাশিত বলেই ওঁর খারাপ লেগেছিল। অলোক বিশ্বাস যেহেতু
নতুন কবিতা লেখেন না, বারীন তাঁকে পছন্দ করেন না। এই কারনেই নিজের অনুগতদের
মাধ্যমে উনি পত্রিকাটিকে ভেঙে দিয়েছিলেন। এটা আমার শোনা কথা। সত্যিমিথ্যে আপনারাও
খোঁজ করে জেনে নিতে পারেন।
৩।
২০০৫ নাগাদ আমি ‘নতুন কবিতা’ পত্রিকার নাম শুনি। শুনতে পাই ‘কবিতা ক্যাম্পাস’-এর
সঙ্গেই ওঁরা ছিলেন। পরে ভেঙে বেরিয়ে আলাদা কাগজ করেছেন। অমিতাভ মৈত্রর টেবিলে
ওঁদের কিছু কপি দেখি। ২০০৬ নাগাদ ওঁদের সঙ্গে ঈষৎ যোগাযোগ হয়। তখন আমি ‘কবিতা
পাক্ষিক’, ‘কবিসম্মেলন’ ইত্যাদি পত্রিকায় নিয়মিত লিখছি। স্বপন রায় কবিতা
চেয়েছিলেন। সম্ভবত ২০০৭-এর বইমেলা সংখ্যায় আমি একটা কবিতা লিখেছিলাম। অকিঞ্চিৎকর
একটি কবিতা। আজ সেই কবিতা আমাকে লজ্জাই দেয়।
৪।
এরপরে স্বপন রায়ের সঙ্গে আমার আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সেই সূত্রেই বারীন ঘোষালের
সঙ্গেও। ওঁরা ভালবাসার একটা আবহে টানেন আমাকে। আমিও ভালবাসি। ওঁদের কবিতাকেও
ভালবাসি, কারণ ওঁরা অন্যরকম লেখেন, আমি সর্বদাই অন্যরকমের সমর্থক। স্বপন রায়ের
সূত্রেই অতনু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। উনি ‘এখন বাংলা কবিতার কাগজ’
করেন। দেখি তিনিও শুধুই ভালবাসার কথা বলেন। এই ভালবাসার মধ্যেই স্বপন রায় প্রস্তাব
দেন ‘নতুন কবিতা’ থেকে একটি বই করার। আমি রাজি হই। ওঁর বাড়িতে গিয়ে পাণ্ডুলিপি
দিই। ২০০৯-এ প্রকাশিত হয় ‘হাইওয়ে’। ২০১২-তেও একটি বই আমি করি বারীন ঘোষালের কথায়-
তার নাম ‘অনুপম % মানুষরা’। এই দুটি বইয়ে আমি নিজের কবিতাই লিখেছি। সেইসব কবিতা
এইদুটি বইয়ে আছে, যেগুলো ‘কবিতা পাক্ষিক’, ‘কবিসম্মেলন’, ‘কৃত্তিবাস’ ‘একদিন (খবরের
কাগজ)’ ইত্যাদি পত্রিকায় প্রকাশিত। ‘হাইওয়ে’-র একটি কবিতাও সম্ভবত ‘নতুন কবিতা’,
‘কৌরব’ বা ‘এখন বাংলা কবিতার কাগজ’-এ বেরোয়নি।
৫।
২০১০-১১ নাগাদ আমি বুঝতে পারি, আমার গায়ে একটা ট্যাগ লাগানো হচ্ছে। আমাকে নোতুন
কোবিতার কবি হিসেবে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। ‘কালিমাটি’ থেকে প্রকাশিত ‘রুবারু’ বই
নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বারীন ঘোষাল ‘এখন বাংলা কবিতার কাগজ’-এ লিখেছিলেন, ‘কিন্তু
অনুপম কবে নতুন কবিতা লিখবে?’ সেটা ২০০৮। আমার মনে তখনই প্রশ্ন লাফিয়ে উঠেছিল,
‘উনি কি আশা করছেন আমি নতুন কবিতা লিখব? কেন লিখব?’ কিন্তু আমি সেই প্রশ্নকে তখন
আমল দিইনি। ভালবাসা এমনই জিনিস। ২০১২-এ স্পষ্ট বুঝলাম আমার পরিচিতিকে ওঁরা নিজেদের
করে নিতে চাইছেন। কিন্তু আমি লক্ষ্য করেছিলাম ওঁদের নিজেদের কোনো কথা নেই। সব কথাই
বারীনের কথা। আর, বারীনের যে কোনো কথাকেই সন্দেহ করতে হয়। ওঁর অনুগামীদের মধ্যে
ওঁর প্রতিমাকে আঘাত করব ভেবে ওঁর একতা সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম ‘এখন বাংলা কবিতার
কাগজ’-এ। উনি প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর ডিপ্লোমেটিকালি দিয়ে এড়িয়ে গিয়েছিলেন। আমি
একটা স্তরের পরে আঘাত করিনি। মানুষটার প্রতি মমতাই ছিল তার কারণ।
৬।
২০১২ থেকে আমি পুনরাধুনিকের ভাবনা শুরু করি। ওঁরা প্রথম থেকেই বিরোধিতা করেছেন।
আমি প্রথম যেদিন ফেসবুকে বললাম আমি ‘পুনরাধুনিক’ নামক একটি ভাবনায় প্রবেশ করছি,
বারীন কমেন্ট লিখলেন, ‘ক্যান্সারাস গ্রোথ হচ্ছে’। সেই শুরু। তারপর আক্রমণ ছাড়া
কিছু উনি দেননি। আমাকে বিশ্রী ভাষায় আক্রমণ করা হয়েছে যে কমেন্টে, সেখানে উনি আর
রঞ্জন মৈত্র লাইক দিয়ে গেছেন। আমি সহ্য করেছি। করে গেছি। মাঝেমধ্যে সীমা অতিক্রম
করলে ফোঁস করেছি। ছোবল নয়। ফোঁস। যাতে ওঁরা একটু সংযত থাকেন।
৭।
বারীনকে নিয়ে আমি ওঁদের প্রকাশিত বই ‘বারীনডাঙা’-এ গদ্য লিখেছি। সেখানে ওঁর
প্রশংসাই আছে। স্বদেশ সেনকে অনুকরণ
করে শুরু করলেও, প্রাণপনে নিজেকে ভেঙ্গেচুরে একরকম একটা জায়গায় নিয়ে গেছেন নিজের
কবিতাকে। কিন্তু তাত্ত্বিক হিসেবে নিজেকে মেলে ধরতে উনি শোচনীয় ব্যর্থ। শুধু
ব্যর্থ নন। উনি বিপজ্জনক। ওঁর নিজের কোনো কথা আমি দেখতে পাই না। সবই অন্যের কথা।
কোনো কথা বিনয় মজুমদারের। কোনো কথা সমীর রায়চৌধুরীর। কোনো কথা ইউরোপ বা আমেরিকার
কোনো চিন্তকের। উনি অকাতরে অন্যের লেখা এবং ভাবনার মধ্যে যাতায়াত করেন, কিন্তু ঋণ
স্বীকার করেন না। করলে ওঁর শিষ্যদের মধ্যে খাটো হয়ে যাবেন, এই কি ভয়? সে যাই হোক,
আমি ওঁর কবিতার আজও অনুরাগী। আমাকে কেউ জিজ্ঞাসা করলেই ওঁর কবিতা পড়তেই
বলব। কিন্তু ওঁর কথা শুনতে বারণ করব। ওঁর কোনো কথাই নেই।
কুমারীর দুধ পড়তে এসে মন দিয়ে এটিও 'পাঠ'করে গেলাম।
ReplyDeleteঅভিজ্ঞতা ! স্তব্ধ।
ReplyDelete