বিখ্যাত এবং
সাময়িক কবিদের ব্যাপার-স্যাপার যে কোনো দেশকালে মিলে যায়। কিন্তু যে কোনো ভাষায় যে
কোনো মহৎ কবির জন্যই কোনো একটি ভিন্ন ট্র্যাজিডি অপেক্ষা করে থাকে। সেটাই তাঁদের
সময়কে অতিক্রম করতে সাহায্য করে। তাঁদের বিরাটত্বও সেটা দিয়ে মাপা যায় (যায় কি?)। স্বদেশ
সেনও বাংলা ভাষায় তার ব্যতিক্রম নন। তিনি এমন এক সময় তাঁর অবিস্মরণীয় কবিতাগুলো
লিখতে শুরু করলেন, বাংলা কবিতা তার আধুনিকের
স্বর্ণযুগ পেরিয়ে এসেছে। উত্তর-উপনিবেশের তলানি পচে দুর্গন্ধ উঠতে শুরু করেছে।
সেটা ছিল আসর মাত করা কবিদের রমরমার সময়। এই সময় সফল প্রতিষ্ঠানগুলো কিছু কবিকে
কবিয়ালের ভূমিকায় নামিয়ে সেলিব্রিটি বানাতে ইচ্ছুক ছিল। কবিরাও সেটা চাইছিলেন।
চিরকাল কিছু কবি অনুগ্রহ চেয়েছেন। আজও চান। কিন্তু রাজার প্রসাদ একজনকে গোপাল
ভাঁড়ের পাশে ভারতচন্দ্র বানাতে পারে, মায়ের সামনে রামপ্রসাদ বানাতে পারে না। খবরের
কাগজ শাসিত বাংলা কবিতার যে এলাকা, সেখানে আলোর বাড়াবাড়ি। সেখানে ঠাকুর সিংহ, রাম
মুচি, যজ্ঞেশ্বরীদের রমরমা। পরিসরটা পুরোপুরি অধুনান্তিক, কিন্তু কবিরা সেটা
শনাক্ত করতে পারছেন না। কবিদের মধ্যে
দার্শনিক এবং তাত্বিক দৈন্য প্রকট হয়ে উঠেছে। কেউ পারছেন না পূর্ণ আধুনিকের দিকেও
যেতে। নিজেদের আংশিক আধুনিকের উদযাপন করার ক্ষমতাও ফেলেছেন হারিয়ে।
হ্যাঁ পাঠক,
স্বদেশ সেনের সঙ্গে তাঁর সমকালীন জনপ্রিয় (?) কবিদের পার্থক্যটা প্রায় একজন
রামপ্রসাদ এবং একজন ভোলা ময়রার বলে আমার মনে হয়। স্বদেশ সেনের পক্ষে দাঁড়াকবি হওয়া
অসম্ভব ছিল। তিনি অধুনান্তিক একটা পরিসরে বসে একটি শতাব্দীর আধুনিকের শেষ কবি হয়ে
উঠলেন। আবার পরবর্তী আধুনিক পরিসরটির দিশারীও হলেন।
সেটা তাঁর
পক্ষে সম্ভব হল কী করে?
মহানগর থেকে
বহুদূরে এক ছোট শহরে বাসের ফলে কি তা সহজ হল?
স্বদেশ সেন
তাঁর নিজের স্বভাব আগলে নিজের চাকরির ছোট শহর জামশেদপুরে একাধিক ছোট কাগজ এবং
তাদেরই প্রকাশনা যেমন ‘কৌরব’ এবং ‘কালিমাটি’-কে অবলম্বন করে বাঁচতে চাইলেন, শান্তি
চাইলেন। তাঁর জীবনে জামশেদপুর বাসের ব্যাপারটা প্রায় এক স্টিগমাটার মতোই। ‘কলকাতার
কবি নন’ ... এই ধারণা স্বদেশ সেন সম্পর্কে ছড়িয়ে থাকল আকাশে বাতাসে বাজারে। কবিতার হার্ড কোর পাঠকরাই তাঁর সম্পর্কে অবহিত। তাঁর নামই
বিরল পাঠকরা জানেন। ইন ফ্যাক্ট, স্বদেশ সেনের নাম জানা এবং তাঁর
কবিতা পড়া একটা স্ট্যাটাস সিম্বল আজ অনেকের কাছে। সেটা আমি কিছু বন্ধু এবং সমবয়সীর
ক্ষেত্রে টের পেয়েছি।
একজন আত্মমগ্ন
সাধক কবি। তিনি সার্থকতার পিয়াসী, সফলতার ততখানি নন। এর ফলে জয় গোস্বামীর মতো সফল
কবিরা তাঁর খবর রেখেছেন, এমনকি খবরের কাগজে লিখেছেন তাঁকে নিয়ে, কিন্তু যখন এই
পরিসরের গুরুত্বপূর্ণ কবিদের প্রসঙ্গ এসেছে, তখন স্বদেশ সেনের নাম সহসা উচ্চারিত
হয়নি। এর কারণ তাঁর বৃহত্তর অপরিচিতি। আবার কৌরবের আশ্র্য় তিনি পেয়েছেন, প্রায় এক
কুলপতি তিনি সেখানে, এক দ্রোণ। ‘কৌরবের কবি’
– এই পরিচয় কি কোথাও গড়ে উঠেছে? তাঁকে সীমাবদ্ধ করতে চেয়েছে? কিন্তু তাতে তাঁর একা হতে তো আটকায়নি।
একজন প্রকৃত আধুনিক কবির মধ্যে আমরা একজন একলা প্রেমিককে পাই। তিনি নিঃসঙ্গ নন।
বিচ্ছিন্ন নন। কিন্তু তাঁর চলার পথে মশাল হাতে অন্য কোনো সহযাত্রী মেলে না। স্বদেশ
সেনও একলা। বারীন ঘোষাল বা আর্যনীল মুখোপাধ্যায়ের মধ্যে তাঁর প্রভাব আছে, সেই
প্রভাবমুক্তি তাঁদের অন্যতম প্রয়াস হয়েছে, কিন্তু তাতে স্বদেশ সেনের কোনো গ্রুপ গড়ে
ওঠেনি। বারীন ঘোষাল কথিত সমাজ-নিরপেক্ষ নতুন কবিতা, বা আর্যনীল কথিত সমাজ-নিরপেক্ষ
পরিবিষয়ক কবিতার সঙ্গে তাঁর কোনো প্রত্যক্ষ যোগই নেই। তিনি তাঁর জায়গায় একা, এবং
একাই। অবিশ্যি তিনি কবিতা না লিখলে বারীন ঘোষাল, স্বপন রায়, রঞ্জন মৈত্র,
ইন্দ্রনীল ঘোষ, দেবাঞ্জন দাস, অমিতাভ প্রহরাজ, আর্যনীল মুখোপাধ্যায়, কাজল সেন,
নীলাব্জ চক্রবর্তী, শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়রা আজ কী কবিতা
লিখতেন, আমার কৌতুহল আছে।
কিন্তু, এঁরা
কেউই কি আজ স্বদেশ সেনের মতো লেখেন?
না।
কখনও সরাসরি
লিখেছেন?
না।
এবং আমি বলতে
চাইব স্বদেশ সেন বাংলা কবিতায় বিশ শতকীয় আধুনিকের শেষ পথিক।
আমি বলতে
চাইবো তিনিই হতে পারেন একবিংশ শতাব্দীর বাংলা কবিতায় পুনরাধুনিকের দিশারী।
এই ২০১৪-এ এসে
দেখতে পাচ্ছি অধুনান্তিক চেতনা দিয়ে নতুন আর কিছু হবে না। তার চেয়ে অনেক দাবি নতুন
আধুনিকের। হতে পারে সেই আধুনিকের চিরবিরাজমানতার সঙ্গে সময়ের যোগ অছিলার চেয়ে বেশি
কিছু নয়।
অনেক ভুল
কবিকে আলোচকরা আধুনিক ধারণার সঙ্গে যুক্ত করেছেন। এর ফলেই আধুনিকের একটা সম্পূর্ণ
ভুল ব্যাখ্যাও ছড়িয়ে রয়েছে বাংলা তথা বিশ্ব কবিতার আকাশে বাতাসে। হয়তো তার পিছনে
আছে বদল্যেরের জেনেটিক আবহাওয়াটির প্রতি অজানিত মোহজাত একটি অপব্যাখ্যা যে, আধুনিক
কবিতা একঘেয়েমি, অবসাদ, আর্তনাদ, আর্তি, অসুস্থতা, পাপ, আত্মধংসের ধারাভাষ্যকে
অবলম্বন করে একমাত্রিকভাবে। সেটা হতেই পারে না। আধুনিক সর্বদাই
অবিসংবাদিতভাবে আলোর দিকে যায়, এবং অন্ধকারের সঙ্গে নাছোড় যুদ্ধ করে। সে তিনি রামমোহন হোন, লেলিন, টলস্টয়, বা
রেমব্রান্ট ... আলোর অপ্রশম্য পিপাসা একজন আধুনিক মানবের থাকতেই হবে। এবং শেষ অবধি
তিনি আলোর জয়ের কথাই বলবেন। মঙ্গলের কল্যাণের শেষ অবধি জিতে যাওয়ায় তাঁর সংশয় থাকবে না। সৃষ্টির পথ আকীর্ণ
করে থাকা বিচিত্র ছলনাজাল তাঁকে অবক্ষয়ের দূত বানাতে পারবে না।
বাংলা কবিতায়
অধুনান্তিকতার সূত্রপাত হয়েছিল জীবনানন্দ দাশের ‘সাতটি তারার তিমির’ কাব্যগ্রন্থ
থেকে। ওই কাব্যগ্রন্থ যখন রচিত হচ্ছিল একটি শতাব্দীর প্রথম পর্ব তথা ভারতীয়
ব্রিটিশ উপনিবেশ ফুরিয়ে আসছিল। আমাদের গত শতাব্দীর আধুনিক ছিল ব্রিটিশ উপনিবেশের
দান। দু-দুটো নৃশংস বিশ্বযুদ্ধ হজম করার পরে, মানুষ যে কতদূর অবধি পশু সেটা
অশ্রু-স্বেদ-রক্তে বুঝে নেওয়ার পরে, দেশ যখন একটা মেকি অস্থির নিজেকে ছিন্নভিন্ন
করা রাজনৈতিক স্বাধীনতার দিকে যাচ্ছে, সেই আধুনিক বিদায় নিতে বাধ্য ছিল। উপনিবেশের
সঙ্গেই আধুনিকের একটা পর্যায় শেষ হচ্ছিল। সে অবিশ্যি শেষ নয়। সে পৌঁছতে চাইছিল
আধুনিকের অন্য এক স্তরে। এই অবস্থায় উত্তর-উপনিবেশ যে সংকর পরিসরের জন্ম দেয়, যে
অনির্দিষ্টতার সৃষ্টি করে, তাকেই অধুনান্তিক বলতে চাইব আমি। জীবনানন্দ তাঁর ওই কাব্যগ্রন্থটিতে তার সূত্রপাত
করেন বাংলা কাব্যভাষায়। তারারও যে তিমির হয়, সে যে আসলে আমাদের যাপনের কুহক,
জীবনানন্দ তাকে টের পেয়েছিলেন।
বাংলা কবিতায় প্রথম এসেছিল কেওস, মিশ্রতা, অনির্দিষ্টতা, প্রলাপ। আসন্ন হয়ে
উঠেছিলেন রবীন্দ্রনাথের অপছন্দের কবি বদল্যের। বুদ্ধদেব বসু তাঁর উপাসনা করলেন। বদল্যেরের
মধ্যে সেই আকর্ষন আছে যা কাউন্ট ড্রাকুলার মধ্যে আছে। স্বীকার করছি, তাঁর কবিতা
আমার প্রিয়, কিন্তু তিনি নিজে প্রিয়তর। কিন্তু এই পরিসরে প্রাসঙ্গিক নন তিনি আর, ভাগ্যিস। এ
এক প্যারাডক্স যে, বাংলা কবিতা থেকে বদল্যেরের আবহাওয়া দূর করার ব্যাপারে অগ্রণী
ভূমিকা নিয়েছে বিশ শতকের শেষে এসে পড়া অধুনান্তিক কথাবার্তা। ওই কথাবার্তাগুলোর
ষাটের দশকে এসে পড়া দরকার ছিল। এমন এক
সময়ে এল, যখন অধুনান্তিক পরিসর ফুরিয়ে আসছে, নতুন আধুনিকের সূত্রপাত হতে চলেছে।
জীবনানন্দর
পরে ষাটের দশকে এই কুহকের এবং আবহাওয়ার সঙ্গে যোগ হয় মলয় রায়চৌধুরীর এবং অন্যান্য
হাংরি কবিদের। হাংরি আন্দোলন আধুনিক আন্দোলন ছিল না। যে কোনো আন্দোলন অধুনান্তিকের
পরিসরে নিয়ে যায়। আধুনিকে শুধু বিপ্লব হতে পারে। বিদ্রোহ নয়। ওই আন্দোলনের দিকে তাকালে
এখন আমার মনে হচ্ছে পরে আলাদা করে অধুনান্তিকের আন্দোলনের প্রয়োজন কিছু ছিল না।
অবশ্য চিন্তকরা হাংরিকে আধুনিকের সঙ্গে যুক্ত করেছেন। হয়তো তার পিছনে আছে
বদল্যেরের জেনেটিক আবহাওয়াটির প্রতি অজানিত মোহজাত একটি অপব্যাখ্যা যে, আধুনিক
কবিতা একঘেয়েমি, অবসাদ, আর্তনাদ, পাপ, আত্মধংসের ধারাভাষ্যকে অবলম্বন করে
একমাত্রিকভাবে। সেটা হতেই পারে না। আধুনিক সর্বদাই আলোর দিকে যায়, এবং অন্ধকারের
সঙ্গে যুদ্ধ করে। সে তিনি রামমোহন হোন, লেলিন,
টলস্টয়, বা রেমব্রান্ট ... আলোর পিপাসা একজন আধুনিক মানবের থাকতেই হবে।
বাংলা কাব্যের
কথা বলছি না, বাংলা কবিতার প্রথম আধুনিক কবি শ্রী মাইকেল মধুসূদন দত্ত আর শেষ
আধুনিক কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কিন্তু রবীন্দ্রনাথে এসেই আধুনিক ফুরিয়ে যায়নি, তার
রেশ আমরা পরবর্তী অনেক কবির মধ্যে দেখি। তাঁদের মধ্যে শেষ গুরুত্বপূর্ণ জন হলেন
স্বদেশ সেন। তাঁর আগে আলোক সরকার ছিলেন। তাঁরও আগে অমিয় চক্রবর্তী। অমিয়-আলোক-স্বদেশ...
এই যাত্রাপথ যেন আপনার চোখের আড়াল না হয়, পাঠক। অনুপস্থিতি আর উপস্থিতিকে এক করে
দেওয়া এক যাত্রাপথ। কবি তাঁর কবিতায় আছেন কি নেই... প্রশ্নটাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়
সেখানে।
একলা একজন কবি
তাঁর অপরিসর কাজের ঘরে কী অসাধ্য সাধন করতে পারেন, স্বদেশ সেন তার উদাহরণ। ভেবে
অবাক হই, স্বদেশ সেন কী করে লিখলেন, কী করে লিখতে পারলেন-
বাছুরের মুখে তার খড় আসে, আসতে দেখা যায়
আমি দেখি সমতল সামান্য কাঁপিয়ে
কি ভাবে প্রস্তুতি আসে
পুরনো ইটের গায়ে দানা পড়ে যায়।
এই চারটি লাইন,
শুধু এই চারটি লাইন লেখার জন্য সারা জীবন এবং সারাজীবনও পর্যাপ্ত নয়। এই চারটি
লাইন যে কোনো উপনিষদের সারাৎসার, আজকের পদার্থবিদ্যাও এদের সামনে নতজানু হতে
বাধ্য। বাছুর, একটি জীবন্ত বস্তু। খড়, একটি পূর্বতন জীবন্ত বস্তু। এদের পারস্পরিক কাছে আসা, একে অন্যের অংশ হবে
বলে, সমতলে কাঁপন লাগায়, সমতল ভাঙে, সামান্যভাবে, অসামান্য এ নয়, অসামান্য কিছুই
তো নয়! অসামান্য কী হতে পারে? জীর্ণতার মধ্যেও যে এক প্রস্তুতি আছে... এই উচ্চারণ
কি আমাদের নিজেদের ত্বকের দিকে তাকাতে বাধ্য করে না? আমাদের আশেপাশে পুরাতন যা
কিছু, পুরাতন যারা ... তাদের প্রস্তুতি আমাদের শিখে নিতে হয়। বাছুর এবং পুরনো ইটের
দূরত্ব ও নৈকট্য আমাদের বুঝে নিতে হয়।
এবং... দেখুন
পাঠক, অক্ষরবৃত্তের কী বিস্ময়কর প্রয়োগ, যা চোখেই পড়ে না, প্রায় গদ্য মনে হয়।
‘আসতে’ শব্দটিতে কী অনায়াসে কেবলমাত্র দুটি মাত্রাই আদায় করে নিলেন স্বদেশ সেন। ‘আস্তে’-র সঙ্গে তার আওয়াজের ফারাক
রইল না। এই মাস্টারি...আড়াল ও বিরল, একমাত্র বিনয় মজুমদার ছাড়া এত অনায়াস আমি
কাউকে দেখি না বিশ শতকের শেষের দিকে।
প্রতিটি শব্দ
তার নিজের ওজন, ভর, বেগ, আসক্তি, জ্যামিতি, ইতিহাস এবং ভৌগলিকতা নিয়ে একটি কবিতায়
নিশ্চিত স্থান পাচ্ছে, এবং তারপরেও সে অনড় থাকছে না, সচল থাকছে, কাঁপছে... এই ঘটনা
স্বদেশ সেনের কবিতায় ঘটতে দেখি। যখন লিখছেন-
নাইতে গিয়ে ঢেলে নাইবে
পথিক বুঝে ডাকবে
ঝকমকানো ঘটি মাজবে
মরবে কেন দোলের দিনে?
অবাক হয়ে
দেখি, আবার সেই চারটি লাইনে, শুধু চারটি লাইনেই দেহাতি দোলের একদিনটি আমার হাতের
নাগালে এসে গেছে, শুধু রঙ মাখলেই হয়, কেউ বারণ করবে না। এই ‘দোলের দিন’ কি ‘পুজোর
দিন’ হতে পারত? ‘ঘটি’ কি নিছক ‘বাসন’ হতে পারত? স্বরবৃত্তের আদলটি মার খেত, শুধু
তাই নয়, অন্য কোনো শব্দ ব্যবহৃত হলে কবিতাটি আর হাতের নাগালের থাকতই না, যে কোনো
একটা কবিতায় পর হয়ে যেত, খুশির বদলে জ্ঞানভরা বাণীর সুর লাগত, ভারি হয়ে যেত
বিচ্ছিরিভাবে।
আবার ‘দোল’-এর বদলে ‘হোলি’-ও লেখা যেত না কি?
‘ঘটি’-র বদলে ‘লোটা’? স্বদেশ সেন তো পশ্চিম বা পূর্ব বঙ্গের অধিবাসী ছিলেন না! উনি
যে ভূখন্ডে বাড়ি এবং চাকরি সামলেছেন সেটা দোলের দেশ নয়, হোলির দেশ। ঝাড়খন্ড।
দেহাতি দোল। কিন্তু এই কবিতায় ‘হোলি’ শব্দটি
ব্যবহৃত হতে পারত না, মৃত্যু তাহলে তার স্ট্যাটাস হারাত, বেঁচে থাকা তার সম্ভ্রম
হারাত। জীবন যে অগাধ বেঁচে থাকার নাম... সেই অগাধ ‘দোল’ চায়, ‘হোলি’ চায় না। আমরা
যে বঙ্গবাসী। যেখানেই থাকি, যেন দোলের বদলে হোলিকে না মেনে নিই। যে দেহাতি মেয়েটি
তার হোলির দিনে লোটা মাজছে, আমরা আমাদের দোলের দিনে তাকে ঘটি মাজতে দেখব, সময় এবং
স্থানের এই মায়াবী খেলা সম্পর্কে ২০১৪-র পুনরাধুনিককে সচেতন হতেই হবে, চাক্ষুস এবং
ভার্চ্যুয়ালভাবে।
স্বদেশ সেন
তাঁর ঝাড়খন্ডে বাস বা প্রবাসকে অপরূপভাবে কাজে লাগিয়েছেন নিজের আধুনিককে এবং
কাব্যভাষাকে গড়ে তুলতে। আমি তীব্রভাবে মনে করি, একজন কবির যে শব্দভান্ডার তার
সঙ্গে অভিধানের কোনো যোগ নেই। একজন কবির যে নিজস্ব ব্যাকরণ, তার সঙ্গে প্রচলিত
সমাজস্বীকৃত সিনট্যাক্সের কোনো সম্পর্ক নেই। কবির কোনো উচ্চারণ কদাপি ক্লোন নয়। তা
এক অপূর্বজাতক। যে কবি এটা যত বেশি পেরেছেন তিনি তত মহৎ হতে পেরেছেন। তাঁর
নির্মিতি সমাজকে খুশি বা অখুশি করে না। সমাজকে শুধু বিস্মিত করে। নতজানু করে। কারণ
তা উচ্ছিষ্ট নয়।
স্বদেশ সেন
পেরেছেন সেই ঋষিসুলভ উচ্চারণে পৌঁছতে। সেক্ষেত্রে তাঁকে অনেকখানি সাহায্য করেছে
ঝাড়খন্ডবাস। বাংলাভাষার শুয়োরের মাংসগুলো তাঁকে রান্না করতে হয়নি, সফল, বা মঞ্চসফল
হওয়ার জন্য তাঁকে সচল হতে হয়নি। বরং আপনমনে তাকিয়েছেন দেহাতি ভাষার দিকে। আমি ব্যক্তিগতভাবে দৃঢ় বিশ্বাস করি,
স্বদেশ সেনের কাব্যভাষায় বাংলা ব্যাকরণ ও বাংলা অভিধানের চেয়ে ঢের প্রাসঙ্গিক হয়ে
উঠেছে বিহার ও ঝাড়খন্ডের আপামর মানুষের ভাষা, যা বাংলা কবিতায় অনুচ্ছিষ্ট তাঁর
আগে। যখন স্বদেশ সেন লিখছেন-
পায়ের তলার হাড়ে গড়া একটা অপ্রচলিত ভূত হয়
একটা ভূত হয় ডান হাতের বুড়ো আঙুলের হাড়ের
তাদের সঙ্গে অরুণাংশুকে আমি সমান্তরাল দেখেছি
এতদিনে
নোংরা হাতে সমস্ত তাস এলোমেলো করতে।
আমার মনে হতে
থাকে, এ নিছক বাংলা নয়। এখানে একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটছে অনেকের নজরের আড়ালে। যে বাংলা
ভাষা ইংরেজির হাত ধরে হাঁটে, তার দাঁড়ি-কমা-কোলন-সেমিকোলন-ড্যাশ-হাইফেন-অনুচ্ছেদ
সবই ইংরেজি থেকে নেওয়া, যে বাংলা ভাষা সংস্কৃত থেকে ইটের পরে ইট ধার নেয়, সে তার
হেলাফেলার প্রতিবেশির দিকে তাকিয়েছে। সে বুঝে নিতে চাইছে রোটি আর ছাতু খাওয়া কঠিন হাড়ের অজ্ঞ লোকগুলো তাদের জিলায় জিলায় কোন সে ভাষায় কম্যুনিকেট করে,
শীতের রাতে আগুনের ধারে ঢোলক বাজিয়ে কোন সে গান গায়!
এর ফলেই ঘটল
এক অসামান্য ঘটনা। উত্তর-উপনিবেশ এবং উপনিবেশের স্মৃতি মুছে গেল স্বদেশ সেনের
কবিতায়। একটি কবিতা স্বয়ং এক অনুবাদ। পরবর্তী অনুবাদ তার হানি করতে পারে, উপকার
করতেও পারে, তাকে একই কবিতা রাখতে পারে না। তবু, চাইলে এই কবির কবিতা আপনি
হিন্দিতে অনুবাদ করতে পারবেন, ওড়িয়ায় অনুবাদ করতে পারবেন, কোনোভাবেই ইংরেজিতে
পারবেন না। স্বদেশ সেনের কবিতার ইংরেজি অনুবাদ অসম্ভব। ইংরেজির মনোযোগী ছাত্র এবং ফাঁকিবাজ শিক্ষক
হিসেবে এ আমার দৃঢ় উপলব্ধ্বি। তাঁকে যে আমি পুনরাধুনিকের দিশারী বলছি, তার অন্যতম
কারণ তাঁর ইংরেজি ভাষার যুক্তিরেখা থেকে নিজের ভাষাকে মুক্ত করে নেওয়া। এর ফলেই
তিনি উত্তর-উপনিবেশ নামক পরিসর থেকে মুক্ত। অধুনান্তিক তাঁকে স্পর্শ করে, বিফল হয়।
দেখুন, কী মণীষা ভর করে আছে এই চারটি বৈদ্যুতিক
লাইনে! ত্রৈলোক্যনাথ বুঝি উঁকি
দিচ্ছেন। উঁকি দিচ্ছে সোমেন পালিত, সে এই অরুণাংশুর পূর্বজ যে!
জীবনানন্দর
সোমেন পালিতের কথা তুললাম। এই তোলা কি অতুলনীয় হল? হ্যাঁ, স্বদেশ সেনের কবিতার
শরীরে মধ্যে মধ্যেই জীবনানন্দর উঁকিঝুঁকি রয়েছে । যখন লিখছেন-
হে অনেক আমগাছের দেশ
তোমার এক মুহূর্ত ভালো লাগছে
ভালো লেগেছিল তোমার সদাসর্বদা।
আমার কিছু
করার থাকে না। ‘হে আমার দেশের মাটি’ মনে পড়ে না, ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে না
কো তুমি’ মনে পড়ে না। মনে পড়ে যায় ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি’। সত্যিই যদি আমার
কিছু করার না থাকে, কী করব বলুন? ওটাই মনে পড়ে। কিন্তু মনে রাখতেই হবে, ওই ‘রূপসী
বাংলা’ বইটিকে জীবনানন্দ দাশ নিজের যোগ্য মনে করেননি। তাঁর কাম্য পরিসরের সঙ্গে ওই
বই খাপ খায়নি। কিংবা ধরা যাক এই লাইনগুলো-
বহুদূরে বুক খোলো, আমরা কোথায় রাখি এ
জন্মের এতগুলি হাত
সমস্ত কবিতা দিয়ে এবারের নীলধরা পিপাসার
জল
বলে দাও একে একে , ধরা থাক সারারাত চাঁদ
বলে দাও সুখ চাই; কার যেন এই কথা ছিল।
কিংবা,
শুধু এই চলে গিয়ে থেমে যাওয়া কোন
সবুজ পোলের কাছে; একমনে ঝরে যাওয়া ভালো।
কিংবা,
আমি অবরোধ নই, শুধু জল, এক ফোঁটা স্বচ্ছতার
রস
আমার শীতের শালে শাদা ফুল ফুটে ফুটে ওঠে
ক্ষুধিত দেশের ধান, বিকেলে গানের ক্ষীর
আমি
এই
মিশ্রকলাবৃত্ত একমাত্র বরিশালের সেই অপ্রতিভ কবি ছাড়া আর কাকে মনে করাবে বলুন তো?
খুব স্বাভাবিকভাবেই জীবনানন্দকে স্বদেশ সেন বুঝে নিতে চেয়েছেন বলে আমার মনে হয়।
জীবনানন্দই তাঁর সামনে একটি প্রাচীর ছিলেন। বলতে পারি, শত্রু ছিলেন। কিন্তু কবিতার
শরীর ফেলুন, আত্মার দিকে তাকান, সেখানে জীবনানন্দ দাশ নামক বিদিশা-প্রেমিক
অধুনান্তিকের দিশারীটি নেই। সেখানে রয়েছেন একজন আবহমান আধুনিক মানব। একজন আংশিক আধুনিক মানুষের সম্পূর্ণ
আধুনিক হয়ে ওঠার আকুতি আপনার চোখ যেন না এড়িয়ে যায়, পাঠক।
এই আংশিকতা
মহামূল্যবান।
এই আংশিকতা
স্থবিরতাকে আটকায়।
একবিংশ
শতাব্দীর আধুনিক জন্ম নিচ্ছে। আমি তাকে বলি পুনরাধুনিক। এই আধুনিকের সঙ্গে বিশ
শতকের আধুনিকের যোগ সামান্য।
এই আধুনিক শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। এই আধুনিক বিশ্বমানবতার
উপলব্ধিকেই আলোকপ্রাপ্তির সমার্থক করেছে। এই যে সর্বমানবের বোধ, তা স্বদেশ সেনের
কবিতায় পাই-
তোমার সাহায্য চাই এই সব করে ফেলবো বলে
সহযোগ কিছু চাই সহজ বন্ধুর মতো
রীতি মিল যেখানে রয়েছে, আর আছে
ধুলো, বালি, কাঁকরের মতো ঠিক আগে পরে থাকা।
এই ‘তুমি’ যে
কোনো ‘তুমি’, তার কোনো দেশকাল নেই, থাকতে পারে না। আজ যখন মানুষের সঙ্গে মানুষের
যোগ সবচেয়ে সহজ হয়ে উঠেছে মোবাইল এবং ইন্টারনেটের দৌলতে, তখনই সম্ভব হয়ে উঠেছে
একজন মানুষের আরেকজনের চেয়ে আরো দূরে থাকা। ভারচ্যুয়াল নৈকট্য শারীরিক দূরত্বকে
বয়ে এনেছে। তা আশীর্বাদ, অবশ্যই, কিন্তু যে কোনো আশীর্বাদের মতোই তার একটা উলটো
পিঠ রয়েছে। পুনরাধুনিক তখনই সার্থক হবে, যখন ঘাম এবং প্রস্রাবের গন্ধ অতিক্রম করে
একজন যে কোনো দেশের মানুষ আরেকজনের পাশে বসতে পারবেন। সীমান্ত বাধা হবে না,
টাইমজোন বাধা হবে না। কারন-
পৃথিবীতে আদ্যোপান্ত ভূত বলে কিছু নেই-
সমস্ত মানুষ
শুধুই উপোসী লতা নেই আজ হদ্দ অমানুষিক
দুধের মুকুলগুলি ঝরে যায় – গাভী আর জল
পড়ে থাকে
আকাশে আপেলটা শুধু জেগে উঠে আবার ঘুমায়!
আমাদের এই
পরিসর আত্মপ্রতিকৃতি ভাঙার। তবেই আমরা অধুনান্তিকের বিদিশা অতিক্রম করে আধুনিকের
দিশাকে ফিরে পাবো, আবার। একটি মাত্র মুখচ্ছবি নয়, যে কোনো মুখচ্ছবিতে নিজেকে
খোঁজার অবকাশ এসেছে। একটা সূর্যে আর কাজ হবে না। আলোকপ্রাপ্তি এখন এক-এর
উপলব্ধিতে। সেই এক- তাকে রবীন্দ্রনাথ খুঁজেছিলেন উপনিষদে, খোঁজ শেষ হয়নি। ‘কে
তুমি’ – প্রথম দিনের সূর্য বা দিবসের শেষ সূর্য কেউই তার উত্তর পায়নি।
স্বদেশ সেনেও
উত্তরটা নেই। প্রশ্নটা আছে। এক অনাদি অনন্ত ম্যারাথনের ব্যাটন সেই প্রশ্ন। বলছেন
বটে-
অস্থায়ী জীবনকে তুমি স্থায়ী করো, তুমি
পূর্ণ করো শেফালী গাছের নিচে জলের
অস্ফূট মূর্তিগুলি
লঘু অঞ্জনের মতো জ্বলে ওঠো গোলাপের মতোন
জ্যামিতি
বেনারসী শাড়িটার নতুন মাখন ওঠো ভেসে।
কিন্তু এ সেই
নাছোড় আশাবাদ, যার জন্য আধুনিকের অপব্যাখ্যাকারীরা রবীন্দ্রনাথকেও ‘অনাধুনিক’ বা
‘প্রাক-আধুনিক’ বলার স্পর্ধা দেখাতে পেরেছেন, ফাল্গুনী রায়কে অমিয় চক্রবর্তী বা
আলোক সরকারের চেয়ে আধুনিক মনে করতে পেরেছেন তাঁরা। মানুষের মনের মধ্যে মন্দের
প্রতি অশুভর প্রতি পাপের প্রতি কীটসুলভ যাপনের প্রতি যে সহজাত আসক্তি থাকে, স্বদেশ
সেন তাকে চরিতার্থ করেননি। কোনো মেফিস্টোফিলিস যদি তাঁর কবিতায় আসে, তাকেও ঐশ্বরিক
হয়ে আসতে হবে, মিলটনের স্যাটানের মতো, মধুকবির রাবণের মতো। এই হল আধুনিক। এর বাইরে
আধুনিক নেই।
জ্যাক দ্য
রিপার বা সানি লিওন আমাদের যে আকর্ষণ করেন, তা নিজের মধ্যে রোধ করাই আধুনিক। ভুল
রাজনীতির ফাঁদে পা না দিয়ে NOTA বোতামে চাপ
দেওয়াই আধুনিক। ভিড় বাসে স্বল্পবাস মেয়েটির দেহ থেকে হাত ফিরিয়ে নেওয়ার ইচ্ছে জেগে
ওঠাটাই আধুনিক। রাস্তায় পড়ে থাকা অসুস্থ মানুষটির দিকে হাত বাড়িয়ে দেওয়ার ইচ্ছে
হারিয়ে না ফেলাটাই আধুনিক-
যাকে বাঁচানো যেত তাকে আর কে কবে
বাঁচালো
কে আর মান্যতা দিলো যেতে যেতে
এগিয়ে গিয়ে দেখলো সারি-হরিতের কাজ?
স্বদেশ সেনের
কবিতায় যিনি মগ্ন হবেন, তিনি যে রাস্তায় ধারে বাস করবেন তার দুই প্রান্তেই
প্রসূতিসদন। কোনো শ্মশান নেই। বাড়িতে নেই কোনো নষ্ট আত্মার টেলিভিসন।
No comments:
Post a Comment