অনুরাগ কাশ্যপের ‘নো স্মোকিং’ এবং দর্শকের বিপদ







আমরা একটা সিনেমার থেকে বড়োজোর আশা করতে পারি, বিনোদনের পাশাপাশি সে আমাদের একটা স্থায়ী স্মৃতি নিয়ে ঘরে ফিরতে দেবে। কিন্তু এমন সিনেমা তো খুবই কম হয়, আমরা সিনেমা হল থেকে নিজেদের জীবনটাই একটু বদলে নিয়ে ঘরে ফিরলাম। এমন সিনেমা কম হয়, এবং এমন সিনেমা নিয়ে আরো কম মানুষ উচ্ছ্বসিত হন। সিনেমা একটা শিল্পমাধ্যম, সাধারণ মানুষকে অস্বীকার করার জো তার নেই, প্রোডিউসারের ঘরে টাকা ফিরিয়ে দেওয়া তার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। তাই, সিনেমা মানুষের জীবনকে নিয়ে কাজ করলেও, কদাচিৎ তাকে বদলানোর সাহস করে, বিশেষ করে আমাদের বলিউডে। এখানে অমিতাভ বচ্চনের মতো ভুবনবিজয়ী প্রায় প্রফেটিক অভিনেতাকেও জয়াপ্রদার সঙ্গে কোমর দোলাতে হয়েছে, সেই কোমরের ক্লোজ শট নেওয়া হয়েছে। এখানে ডেভিড ধাওয়ানের মতো লোকেরা নাকি বাড়িতে ডিভিডি চালিয়ে ত্রুফো-গদার দেখেন, কিন্তু নিজে বানানোর সময় একটা ‘বিবি নং ১’-ই বানান।
এই হার্ডকোর বাজারখোর হিন্দি সিনেমা কয়েকবার তার খোপ থেকে বেরিয়েছে, এবং সারা আকাশটা উড়তে চেয়েছে। আকাশের গায়ে তার ডানার ঝাপট দাগ করে দিয়েছে। সেটাও সে আবার করেছে নিজের বাকি ধর্মগুলো মজুত রেখেই। আমি নিজে এই ব্যাপার আমার এই ২০ বছরের দর্শকজীবনে দু-চারবার ঘটতে দেখেছি, লাফাতে লাফাতে বাড়ি ফিরেছি। এরকম কয়েকটি সিনেমার নাম ১।  উর্মিলা মার্তন্ডকার-মনোজ বাজপেয়ী অভিনীত রামগোপাল বার্মা পরিচালিত ‘কওন’ (১৯৯৯) ২। অমিতাভ-মনোজ বাজপেয়ী অভিনীত, রাকেশ ওমপ্রকাশ মেহরা পরিচালিত ‘অকস’ (২০০১) ৩। অমিতাভ-জাভেদ-গুলশন গ্রোভার-জ্যাকি শ্রফ-পদ্মা লক্ষ্ণী-ক্যাটরিনা অভিনীত কাইজাদ গুস্তাদ পরিচালিত ব্ল্যাক কমেডি ‘বুম’ (২০০৩) ৪। সেফ আলি খান-ডিম্পল কাপাডিয়া-বোমান ইরানী-নাসিরুদ্দীন শাহ অভিনীত হোমি আদজানিয়া পরিচালিত ‘বিইং সাইরাস’ (২০০৫) এবং ৫। জন আব্রাহাম-আয়েশা টাকিয়া-রণবীর শূরী-পরেশ রাওয়াল অভিনীত অনুরাগ কাশ্যপ পরিচালিত ‘নো স্মোকিং’ (২০০৭)।
এই সিনেমাগুলো ‘ভালো’ সিনেমা নয়। কয়েকটি তো বেশ ‘খারাপ’ সিনেমা, যেমন ধরুন ‘বুম’ অথবা ‘বিইং সাইরাস’। আমাদের দর্শক এগুলো হলে বসে দেখবে, ইহা অসম্ভব বলিয়া বোধ হয়।
আসলে এই সিনেমাগুলো ভাল এবং খারাপের ভেদ কাটিয়ে সেই জায়গায় পৌঁছেছে যে শুধু এদের গুরুত্ব নিয়েই কথা বলা যায়, আর কিছু নয়।
‘নো স্মোকিং’-এর মতো একটা ঘটনা, যেমন ধরা যাক, ভারতীয় পর্দায় ঘটতে পারে, এটা ভাবা যায় না ২০০৭-এ। বিনোদনের আশা নিয়ে ঢুকলে বেরোনোর সময় নিজেকে ধিক্কার দেওয়ার গ্লানিটা নিয়ে আসতে হবে। দর্শক তো দূরের কথা, সম্ভবত স্বয়ং সিনেমাই এর জন্য প্রস্তুত ছিল না সেটা নির্মাণের কারণে নয়। একাধিক ফ্রেমে এই সিনেমাকে হলিউডি সিনেমা মনে হয়েছে, টেকনিকাল প্রাইজ পেয়েছে এই ছবি দেশি সমালোচকদের বিচারে, কিন্তু সেটার জন্য নির্মাণের অভিনবত্বে আন্তর্জাতিক দাবিটা থাকে না।
মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন জন আব্রাহাম, আয়েশা টাকিয়া, রণবীর শূরী, আর পরেশ রাওয়াল। জন আব্রাহামকে মেনে নিতে অনেকের সমস্যা হতে পারে। আমার হয় না। ওঁর মুখে অভিব্যক্তি কম। খুব অল্প কিছু এক্সপ্রেশন নিয়ে উনি কাজ করতে বাধ্য হন। কিন্তু একবার যদি ভেবে দেখি রবার্ট ব্রেসঁ নামক সেই মহান পরিচালকের কথা, তিনি তো নন-এক্টরদের নিয়েই কাজ করেছেন ! তাঁর ‘ডেভিল, প্রব্যাবলি’ সিনেমার অভিনেতাদের মুখ তো পাথরের চেয়েও কম বাঙময়। জন এব্রাহাম অবশ্যই একজন নন-এক্টর। এবং এই সিনেমায় k-র চরিত্রের জন্য সেটাই দরকার ছিল। একজন অভিনেতা এই চরিত্রে নিজের কিছুটা হলেও মেশাতে চাইতেন, অনুরাগ কাশ্যপ সেটা রোধ করতে পারতেন না। জনকে পাওয়ার ফলে তিনি সেটাই করেছেন যেটা চাওয়া হয়েছে, একজন পাপেটের মতো। আর, এই চরিত্রটা আসলে এক পুতুলেরই। তবে পরেশ রাওয়াল বা রণবীরের মতো প্রকৃত অভিনয়-শিল্পীদের সামনে যখন তিনি দাঁড়িয়েছেন, এমনকি আয়েশা টাকিয়ার অভিব্যক্তিময় মুখের সামনে, তাঁকে মেনে নিতে অভিনয়মোদী দর্শকের সমস্যা হতে পারে।
ক্যামেরা এই ছবিতে আন্তর্জাতিক মানকে ছুঁয়ে থেকেছে, তাকে পেরোতে চায়নি। সেটার প্রয়োজনও ছিল না। আজ ক্যামেরার কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে নিজেকে মুছে দেওয়া, নিজেকে জাহির করা নয়। সেটা হয়তো সম্ভব হতে পারে দর্শককে ক্যামেরার উপস্থিতি জানান দিয়েই, একজন আব্বাস কিয়ারোস্তামি যেটা করেন, গদার যেটা ষাটের দশকেই করেছিলেন বিগত শতকের, এবং... আমাদের মৃণাল সেন। এই সিনেমা ক্যামেরা নিয়ে অমন কোনো কাজ করেনি। এই সিনেমার ক্যামেরার চোখে হলিউডের চশমাই পরানো আছে।
‘নো স্মোকিং’-এর একমাত্র আন্তর্জাতিক অভিনবত্ব ছিল অন্য জায়গায় সুররিয়াল, হরর, ফ্যান্টাসি, ড্রিমস, রিয়ালিটি... এগুলোর আপনি ক্ষণিক দেখা পাবেন ভিন্ন-ভিন্ন মোড়ে, কখনো তারা একলা, কখনও হাত ধরে আছে একে অন্যের। তারা এসেছে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যকে মিলিয়ে দিয়ে। তারপরেই দেখবেন তারা নিজেরাই মিলিয়ে গেছে, আপনি বিশ্রীভাবে নির্দিষ্টতা খুঁজছেন। এই সিনেমা বিষয়ের ধারণাকে আড়ালে চুরমার করে প্রকাশ্যে এক অন্য বিষয়ের অবতারণা করতে পেরেছিল। সেটা সারা পৃথিবীতে তখন ঘটে-ঘটে অনেকটাই পুরোনো হয়ে গেছে। কিন্তু এই সিনেমাটি সেই কাজ যেভাবে করেছিল, আগে কোথাও হয়নি বলেই আমার মনে হয়। ‘নো স্মোকিং’ আসলে সাহিত্য এবং সিনেমার মেলবন্ধনকে অভূতপূর্বভাবে কাজে লাগিয়েছিল। অনায়াসে মিলিয়ে দিয়েছিল স্টিফেন কিং এবং ফ্রাঞ্জ কাফকাকে। এই সিনেমার নায়কের নাম K সরাসরি চলে যাই ‘দ্য ট্রায়াল’ এবং ‘দ্য ক্যাসল’-এর জগতে।
কিন্তু কাফকার জগতে সিগারেট খাওয়া মানা নয়।
‘সিগারেট টানা স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর’ এই কথাটিকে অবলম্বন করে ‘নো স্মোকিং’-এর আগে রামগোপাল তাঁর ‘ডরনা মানা হ্যায়’ (২০০৩) সিনেমার একটি অংশ বানিয়েছিলেন। কিন্তু অনুরাগ কাশ্যপ সেটাকে হরর সিনেমার ঘরাণায় আটকে রাখলেন না, এমনকি সিনেমার চরমে পৌঁছেও সেটাকে সিনেমাতেই থামিয়ে দিলেন না, পৌঁছে দিলেন জীবনদর্শণের স্তরে। ছবিটা দেখতে বসে আমাদের সামনে গুলিয়ে যায় নৈতিকতা, বিচার, এবং প্রতিষ্ঠানের মূর্তিগুলো। মুক্তি আর গোলকধাঁধা... কোনোটাই হয়তো স্বতন্ত্র আসে না আমাদের জীবনে। আপনি সিগারেট টানবেন, আপনার একটা আঙ্গুল কেটে নেওয়া হবে। আপনি আরেকজনকে সেই বিচারব্যবস্থার মধ্যে টেনে আনবেন, আপনার আঙ্গুল ফেরত পাবেন।
আর অপরাধ?
অসংখ্য চোখ যেন আপনাকে ঘিরে আছে। চোখ শব্দটা দিয়েই আপনার শরীর-মন-আত্মাকে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে।
এ এক কাফকাসুলভ বিচারব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন অনুরাগ কাশ্যপ। পরেশ রাওয়াল অভিনীত বাবা বাঙালি চরিত্রটি অবিস্মরণীয় তিনি গড়েছেন এক পেনাল কলোনি। লোকে সিগারেটের হাত থেকে মুক্তির আশায় আসে তাঁর কাছে, ফিরে যায় এক বিচারব্যবস্থায় সইসাবুদ করে। সেই বিচারের আওতায় ন্যায়-অন্যায় ব্যাপারটা বোঝা যায় না, কেউ বোঝাতেও চায় না।
মজার ব্যাপারটা হল, হিন্দি সিনেমার দর্শক যা চায়, এই ছবিতে তার চেয়ে সবকিছুই বেশি বৈ কম নেই। এ একটা খেলা। কাফকার পাঠক যা আশা করবেন, তিনিও এখানে তার চেয়ে বেশি অথবা কমই পাবেন। সেও একটা খেলা। এই সিনেমার শেষে যখন আত্মার লন্ড্রিতে আমরা পৌঁছই, আত্মাদের সেখানে সাফ করা হচ্ছে, মনে পরে বেদান্ত, মনে পড়ে যান ডাব্লিউ বি ইয়েটস, মনে পড়ে যায় দান্তের পারগেটরিকে। বুঝতে পারি এই সিনেমা দেখতে বসে আমরা নিজেদের মতো করে একটা ডিভাইন কমেডির অভিজ্ঞতা পেয়েছি। আমাদের মনেরই একটা অংশ এই ছবির নায়ক, আরেকটা অংশ নায়িকা, আরেকটা অংশ হল এই ছবিতে সিগারেট স্মোকিং-এর জন্য নির্ধারিত ও অনির্ধারিত বিচারব্যবস্থা। আমরা যেটা করলাম, সেটা আসলে মানসভ্রমণ।
এই সিনেমা অনেকটাই মনে করিয়ে দেয় ‘এলিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড’-কেও। অবিশ্যি ওই বইয়ের প্রভাব স্বয়ং কাফকার উপরেও তো ছিল!
সমস্যাটা হল, ‘নো স্মোকিং’ শুধু একটা সিনেমা নয়, প্রচলিত সিনেমার চেয়ে ঢের বেশি বা কম একটা কিছু।
বিপজ্জনক। অপমানজনক।
অবিশ্যি শেষ দৃশ্যে বিপাশা বসুর আইটেম নাচ সেই অপমান ভুলে ঘরে ফিরতে সাহায্য করবে। বিস্মরণের চেয়ে বড়ো ত্রাতা আমাদের আর কে আছে বলুন না?

2 comments:

  1. ei cinema ta amar khub priyo akta cinema..amar mone hoy dorshok ba besir vag dorshok mon k jerk dite chay ba disturb korte chay sei dhoroner kaj khub akta accept korena..tar karon shilpo samporke prokrito shikha na thaka bole amar mone hoy..tar mane shikhito dorshok nei ta bolchi na kn2 majority hoyto cinema k akta medium of entertainment hisebei dekhte chay..kn2 asole ta to noy cinema akta shilpo madhyom ebong tar universe sima hin..se ja hocche tar theke alada ba notun vabei kchu korte chay kn2 tate element of entertainment nao thakte pare..besi brain beyam sapekho cinema dekhte tara avostyo to nai ebong dekhte chay o na...ei conflict ta sobsomoy chhilo r thakbeo..prokrito shilpo r entertaining cinema ei duyer modhye birodh nei shilpi k hoyto nijer kaj kore jete hoy..sei karon ei hoyto anek valo shilpokormo summarily rejected hoy anek samoy...

    ReplyDelete
  2. Coin Casino - Get a £100 Bonus at Online Casinos
    If 코인카지노 먹튀 you want to take advantage of Coin Casino Casino's fantastic promotions, they've got the best odds. With the generous sign up bonus and a £100

    ReplyDelete